Sunday, May 10, 2015

সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি প্রায় বন্ধ:প্রথম অালো

সরকারিভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য নাম নিবন্ধন করেছিলেন সাড়ে ১৪ লাখ যুবক। কিন্তু গত তিন বছরে তাঁদের মধ্যে মাত্র সাত হাজার যেতে পেরেছেন। কয়েক মাস ধরে এই প্রক্রিয়াও বন্ধ। অন্যদিকে একই সময়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন দেড় লাখ মানুষ। আর ছাত্র ও পর্যটক সেজে গেছেন আরও অন্তত এক লাখ। জনশক্তি রপ্তানিকারক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে যাওয়ার কারণেই মানুষ এখন জীবনের ঝ
ুঁকি নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। কারণ, কোনোভাবে যেতে পারলেই কাজ মিলছে। এভাবে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি দেওয়ায় অনেক মানুষ যেমন প্রাণ হারাচ্ছেন, তেমনি থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়া উপকূলে গড়ে উঠছে বন্দিশিবির। মিলছে অসংখ্য মানুষের কবর। আবার পর্যটক ও ছাত্র সেজেও প্রতিনিয়ত মালয়েশিয়া যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। সেই সংখ্যাও বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার। সেই হিসাবে গত তিন বছরে অন্তত তিন লাখ লোক এভাবে মালয়েশিয়া গেছেন। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম তিন মাসেই বঙ্গোপসাগর দিয়ে ২৫ হাজার লোক সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর অর্ধেকেরই বেশি বাংলাদেশি। আর ২০১২ সাল থেকে গত তিন বছরে এভাবে বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়া গেছেন অন্তত দেড় লাখ। অথচ এ বছরের চার মাসে সরকারিভাবে ৭১৬ কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পেরেছেন। আর গত তিন বছরে গেছেন আট হাজার। এর মধ্যে এপ্রিলে মাত্র ২৮ জন কর্মী যাওয়ার পর থেকে নতুন করে আর কেউ দেশটিতে যেতে পারেননি। মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো মনে করি না, মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো আমরা চাহিদাপত্র পাচ্ছি। তবে মালয়েশিয়া নিয়ে যে আশা ছিল, সেটা পূরণ হয়নি।’ তবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য তিনি দায়ী করছেন যাঁরা যাচ্ছেন তাঁদেরই। তিনি বলেন, এটি বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া। ২০০৭সালে ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ জন এবং ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন মালয়েশিয়া গেছেন। ২০০৯ সালে দেশটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর বেসরকারি ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে সরকারিভাবে দেশটিতে কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর সরকারিভাবে কর্মী পাঠাতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। সে সময় দেশটি বলেছিল, প্রথম দফায় ৫০ হাজার লোক নেবে। আর প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেছিলেন, বছরে অন্তত এক লাখ লোক মালয়েশিয়া যাবে। পাঁচ বছরে যাবে পাঁচ লাখ। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। গত তিন বছরে মাত্র সাড়ে আট হাজার চাহিদাপত্র এসেছে। আর গেছেন ৭ হাজার ১৯০ জন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারিতে ৪০৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১১৯, মার্চে ১৬১ ও এপ্রিলে ২৮ জন মালয়েশিয়া গেছেন। ২০১৪ সালে বৈধভাবে ৫ হাজার ১৩৪ জন আর ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৮৫৩ জন গেছেন দেশটিতে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার এই ধীরগতিতে সরকারও হতাশ। গত বছর বাংলাদেশের প্রতিনিধি মালয়েশিয়া সফরের সময় এ হতাশার কথা বলে এসেছেন। এরপর গত বছরের আগস্টে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রায়ত জায়েমের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে আসে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, মালয়েশিয়া সব খাতে কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এরপর বাজার সম্প্রসারণের বদলে আরও সংকুচিত হয়েছে। আর অবৈধভাবে কর্মী যাওয়া বাড়ছেই। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে গত তিন বছরে ১ লাখ ২০ হাজার লোক সাগরপথে মালয়েশিয়া গেছে। আর এ বছরের তিন মাসে ২৫ হাজার ধরলে এ সংখ্যা দেড় লাখ। সাগরপথে এভাবে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে নিখোঁজ অর্ধশত পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। নিখোঁজ পরিবারের সদস্যরা জানান, দালালেরা খুব অল্প টাকায় মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে নৌকায় তোলে। পথেই তাঁদের জিম্মি ও নির্যাতন করে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। এরপর থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার বন্দিশিবিরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। অনেক সময় টাকা দিয়ে মুক্ত হয়ে তাঁরা কাজ পান। টাইম সাময়িকী ও যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডের চিংড়ি ও সি ফুড শিল্পে কর্মরত সাড়ে ছয় লাখ শ্রমিকের মধ্যে তিন লাখই ক্রীতদাস হয়ে কাজ করছেন। এঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি, যাঁদের সাগরপথে মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে এখানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ছাত্র ও পর্যটক সেজেও অনেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। ৩ মে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ছাড়পত্র ছাড়াই এভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস থেকে ১২ জন এবং মালির এয়ার থেকে সাতজনকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে বিএমইটির একজন কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়া নিয়ে ২০১২ সালেই আমরা নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর বাস্তবতা হলো সরকারিভাবে লোকজন যেতে না পারার কারণেই এভাবে মানব পাচার বেড়েছে।’ জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনে অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবদুল বাসার প্রথম আলোকে বলেন, বৈধভাবে বিদেশে যাওয়া বাড়ানো ছাড়া এ সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় নেই।  

No comments:

Post a Comment