নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ওরফে মুফতি হান্নানকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয় ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর। ২০০৪ সালে তখনকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলার ঘটনায় উদ্ভূত হত্যা মামলায় সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ওই রায় দেন। মুফতি হান্নানের দুই সহযোগী শরীফ শাহেদুল বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় একই মামলায়। মুফতি হান্নান ও ব
িপুল কারাগারে আছেন, রিপন পলাতক। এই তিন জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) বিষয়টি সাড়ে পাঁচ বছর ধরে শুনানির অপেক্ষায় আছে হাইকোর্টে। বিভিন্ন মামলায় এই তিন জঙ্গিসহ ২৯ ভয়ানক জঙ্গিকে বিভিন্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড দেন, যাদের মধ্যে শায়খ আবদুর রহমানসহ ছয় জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ২১ জন কারাগারে আছে। ওই জঙ্গিদের ডেথ রেফারেন্স দীর্ঘদিন ধরে শুনানির অপেক্ষায় আছে হাইকোর্টে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এসব ডেথ রেফারেন্স শুনানির কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কারাগারে থাকা জঙ্গিরা এখনো যোগাযোগ রেখে চলেছে বাইরে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে। আর এ কারণে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক জঙ্গিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহের একটি মামলায় হাজির করার জন্য নেওয়ার সময় ফিল্মি স্টাইলে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। ওই জঙ্গিরা হলো নিষিদ্ধ ঘোষিত জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) বোমা বিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন ও রাকিব হাসান এবং বোমা মিজান। রাকিব পরে ধরা পড়ে। এদিকে ঢাকার রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় উদ্ভূত হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে মুফতি হান্নানকে। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা, সিলেট, নোয়াখালী, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, হবিগঞ্জে আরো ৩৫টি মামলা আছে। এসব মামলায় প্রায়ই তাঁকে কারাগার থেকে ওই সব আদালতে হাজির করতে হয়। তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও আসামি। দেশের বিভিন্ন আদালতে তাঁকে নেওয়ার কারণে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কয়েকবার পিছিয়ে দিতে হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গি সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে প্রায় ৪০টি এবং রাকিব হাসানের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০টি মামলা রয়েছে। সালাউদ্দিন তিনটি মামলায় এবং রাকিব একটি মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত। আইনজীবীরা মনে করেন, একটি মামলায় ফাঁসি কার্যকর হলে এদের বিভিন্ন আদালতে হাজির করার প্রয়োজন হতো না। ফলে পালানোরও সুযোগ পেত না তারা। কিন্তু তাদের ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য অগ্রাধিকারমূলক কোনো ব্যবস্থা এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, হাইকোর্টে কোন মামলা কোন বেঞ্চে শুনানি হবে তা নির্ধারণ করেন প্রধান বিচারপতি। তাই জঙ্গিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের বিষয়ে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা যায় কি না সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির। সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা হবে কি না জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'বিশেষ ব্যক্তির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তাদের মামলা দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করা গেলে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করার প্রয়োজন হবে না।' তিনি বলেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে, সেসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিশেষ পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অবশ্যই দ্রুত ডেথ রেফারেন্সগুলো নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আরো যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে, সেসব মামলা নিষ্পত্তিতেও সুবিধা হয়।' সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, 'জঙ্গিদের মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা এই সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। জঙ্গি নির্মূলের জন্য এটা করা প্রয়োজন। তারা ভয়ংকর অপরাধী। কিছু জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হলে, নতুন যারা জঙ্গিবাদে ঝুঁকছে তারা ভয় পেত। ২০০৫ সালে বোমা হামলার ঘটনায় উদ্ভূত একটি হত্যা মামলায় জেএমবির জঙ্গি আমজাদ হোসেন বাবু ও এইচ এম মাসুমুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেন লক্ষ্মীপুরের দায়রা জজ আদালত। ২০০৬ সালের ১৫ আগস্ট রায় দেওয়া হলেও এখনো ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়নি হাইকোর্টে। একই বছর বোমা হামলা মামলার ঘটনায় শরীয়তপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসির নির্দেশ দেন কামারুজ্জামান ওরফে স্বপন নামের এক জঙ্গিকে। ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিলেটের দায়রা জজ জঙ্গি আক্তারুজ্জামানকে, ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ জঙ্গি আসাদুজ্জামানকে, ২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জঙ্গি আবুল কালাম ওরফে শফিউল্লাহকে বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার মামলায় ফাঁসির নির্দেশ দেন। এসব আসামির ডেথ রেফোরেন্সও এখনো শুনানি হয়নি। পুলিশের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে এক থেকে ৪০টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে। সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তালিকা করে এদের ডেথ রেফারেন্স শুনানির ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের এসব জঙ্গির বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকায় প্রায়ই তাদের নিয়ে যেতে হয় বিভিন্ন জেলায়, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে সব জঙ্গি কারাগারে : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুফতি হান্নান কাশিমপুরে ২ নম্বর কারাগারে আছেন। রমনা বটমূলে বোমা হামলার হামলার ঘটনায় উদ্ভূত হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হুজির জঙ্গি আরিফ হাসান সুমনও কাশিমপুর কারাগারে। গাজীপুর আদালতে বোমা হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জেএমবি সদস্য মো. নিজাম উদ্দিন ওরফে রনি ওরফে রেজা, আরিফুর রহমান ওরফে হাসিব ওরফে আকাশ, সাউদুল মুন্সী ওরফে ইমন ওরফে পলাশ, মাসুদ ওরফে আনিসুল ইসলাম ওরফে ভুট্টু, আবদুল্লাহ আল সোয়াইল ওরফে ফারুক ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে আকাশ, এনায়েতুল্লাহ জুয়েল ওরফে ওয়ালিদ, তৈয়বুর রহমান ওরফে হাসান, মামুনুর রশিদ ওরফে জাহিদ, আশ্রাফুল ইসলাম ওরফে আব্বাস খান ও আদনান সামী গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অনেক মামলা বিচারাধীন। প্রত্যেককেই বিভিন্ন আদালতে হাজির করতে হয়। বিভিন্ন মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি আমজাদ হোসেন বাবু, এইচ এম মাসুমুর রহমান, কামারুজ্জামান ওরফে স্বপন, আক্তারুজ্জামান, আসাদুজ্জামান ও আবুল কালাম ওরফে শফিউল্লাহ গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার ও কাশিমপুর কারাগারে আছে।
No comments:
Post a Comment