Sunday, May 10, 2015

সালাহ উদ্দিনকে কেউ খুঁজছে না:কালের কন্ঠ

বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না গত ১০ মার্চ থেকে। অবরোধ-হরতালের ঘোষণাসহ অজ্ঞাত স্থান থেকে বিবৃতি দেওয়ার মাধ্যমে হঠাৎ আলোচনায় আসা এ নেতার পরিবারের সদস্যদের দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে রাতে উত্তরায় আত্মীয়ের বাসা থেকে তাঁকে ‘ধরে নিয়ে গেছে’। তবে পুলিশের দাবি, বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামি হিসেবে তিনি আত্মগোপনে আছেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য খোঁজা হচ্ছে। এ রকম পাল্টাপাল্টি দ
াবির মধ্যে পেরিয়ে গেছে দুই মাস। সালাহ উদ্দিন আহমেদের হারিয়ে যাওয়া ও খোঁজের বিষয়টি ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে রহস্যের গভীরে। কূলকিনারাহীন এ ঘটনার রহস্যভেদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গুরুত্বপূর্ণ এ নেতার ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকেও কঠোর কোনো আন্দোলনের ঘোষণা আসেনি। এ বিষয়ে স্ত্রী হাসিনা আহমেদ ছাড়া আর কারো কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। এ সময়ের মধ্যে নিখোঁজ সালাহ উদ্দিনের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেলেও তাঁর ভাইবার অ্যাকাউন্ট গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল বলে প্রমাণ মিলেছে। আর তাতে অবস্থান হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে অন্য দেশের নাম। গোয়েন্দা সদস্যরা এ বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। সালাহ উদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার আগে পুলিশ-র‌্যাবের কিছু অভিযান আলোচনায় থাকলেও গত দুই মাসে পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা কোনোভাবেই দৃশ্যমান হয়নি। এ অবস্থায় আদালতের নির্দেশে তাঁকে যে খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে তা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। উত্তরার আত্মীয়ের বাসা থেকে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ করা হয়েছে বলে দাবি করছেন স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। কিন্তু পুলিশ প্রাথমিক তদন্তের পর জোরালোভাবে জানিয়েছে, ওই বাসায় সালাহ উদ্দিন ছিলেন না। আর তাঁকে পুলিশ-র‌্যাবের কোনো টিম তুলে আনেনি। এ অবস্থায় ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনাটি জটিলতার দিকে চলে যায়। এরপর যতই সময় গড়াচ্ছে ততই রহস্যের আবরণে ঢাকা পড়ছে প্রকৃত ঘটনা। তবু আশাবাদী হাসিনা আহমেদ : সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই তাঁর স্বামীকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এর বাইরে আর কোনো বক্তব্য গ্রহণ করতে রাজি নন তিনি। স্বামীকে ফেরত পেতে তিনি পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু সাড়া মেলেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি দুই দফা চেষ্টা করেছেন। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কয়েকবার দেখা করে একই কথা জানিয়েছেন। হতাশাজনক এ পরিস্থিতির মধ্যেও হাসিনা আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব রকম চেষ্টাই চলছে। এখন প্রতীক্ষায় আছি। এ ছাড়া তো আর কিছু করার নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উত্তরার বাড়িটিতে গিয়েছিলেন এবং সালাহ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে গেছেন। এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এখন তাঁরা অস্বীকার করছেন। প্রধানমন্ত্রী ও সরকার চাইলেই তাঁকে ফেরত পাওয়া সম্ভব। সে চেষ্টা করছি। আমরা এখনো তাঁর কোনো খোঁজ পাইনি। আশায় আছি।’ পুলিশের দাবি খোঁজা হচ্ছে : দৃশ্যমান প্রচেষ্টা না থাকলেও পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, সালাহ উদ্দিন আহমেদের খোঁজ চলছে। আর এ ব্যাপারে অগ্রগতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত জানানো হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পলাতক আসামি হিসেবে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে খোঁজার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। তাঁর স্ত্রী যে অভিযোগ করেছিলেন, সেটিও তদন্তাধীন। পুলিশের পক্ষ থেকে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর তদন্ত অগ্রগতির সংবাদ আদালতকে জানানো হচ্ছে। তিনি আত্মগোপনে আছেন, নাকি নিখোঁজ, সে বিষয়টির নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। তবে পুলিশ বা র‌্যাব তাঁকে আটক করেনি, সে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা হয়েছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের।’ ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘ওনার (সালাহ উদ্দিন) ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। পরিবারের অভিযোগের ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ সক্রিয় ভাইবার অ্যাকাউন্ট : সালাহ উদ্দিনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বর দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় মাঝেমধ্যে একটি ভাইবার অ্যাকাউন্ট থেকে ফোন করে তিনি যোগাযোগ রাখতেন গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে। সেই ভাইবার অ্যাকাউন্টটি গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল বলে জানা যায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এ অ্যাকাউন্ট সচল থাকা মানেই যে সেটি সালাহ উদ্দিন আহমেদ ব্যবহার করেছেন, তা নয়। তবুও যাচাই করা হচ্ছে। ভাইবার অ্যাকাউন্টে সেটির অবস্থান বিষয়ে আফ্রিকার একটি দেশের কোড বহন করছে, যা রহস্যপূর্ণ। তাঁর সব ফোন নম্বর নানাভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে দাবি করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। প্রতীক্ষা হাবিব হাসনাত ঘিরে : সালাহ উদ্দিন যে ফ্ল্যাটে আত্মগোপনে ছিলেন বলে স্ত্রী দাবি করেন, সেটিতে বসবাস করতেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ডিএমডি সৈয়দ হাবিব হাসনাত। স্ত্রী সুমনা হাসনাতসহ তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন দীর্ঘদিন। ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, হাবিব হাসনাত ছুটিতে আছেন। তবে কোথায় আছেন তা জানা নেই। ওই ভবনের অন্য বাসিন্দারা তাঁর অবস্থান বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। হাবিব হাসনাতের ছেলেমেয়ে কানাডায় থাকেন। তাঁরা সেখানেই যেতে পারেন বলে ধারণা অনেকের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘নিকটাত্মীয় হাবিব হাসনাতই জানিয়েছিলেন সালাহ উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে। তিনি তখন দেশের বাইরে ছিলেন। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। তিনি কোথায় আছেন, তা জানতে পারিনি।’ পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা হাবিব হাসনাতের বিদেশ গমন ও ফেরত আসার বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী আশরাফুল ও আকতার পুলিশকে বলেছিলেন, ‘১০ মার্চ সন্ধ্যার দিকে স্যার ও ম্যাডাম বাসা থেকে চলে যান। যাওয়ার সময় বলেছিলেন, বাসায় এক আত্মীয় আছেন। তিনি থাকবেন। কিছু সমস্যা হলে তোমরা দেখবে। কিন্তু সেই আতীয় সালাহ উদ্দিন আহমেদ, এমন কথা বলেননি। ওই দিন আনুমানিক রাত সাড়ে ৯টার দিকে ছয়-সাতজন লোক বাসায় আসেন। তাঁরা গেট খোলা পেয়ে সরাসরি দ্বিতীয় তলায় চলে যান। পরিচয় জানার চেষ্টা করলেও তাঁরা কোনো কথা বলেননি। পরে দ্বিতীয় তলা থেকে এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসেন ওই ব্যক্তিরা। তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কি না তা আমরা জানি না। তাঁদের পোশাকে কোনো কিছু লেখা ছিল না।’ উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি নম্বর রোডের ৪৯/বি নম্বরের বাসিন্দা হাবিব হাসনাত যেমন দেশে ফেরেননি, তেমনি আলোচিত এ দুজন নিরাপত্তাকর্মীও কাজ ছেড়ে চলে গেছেন। ভবনের বাসিন্দারা পুলিশি ঝামেলা এড়াতে বদল করেছেন ঘটনার কথিত প্রত্যক্ষদর্শী দুই নিরাপত্তাকর্মীকে। আশরাফুল ও আক্তার নামের ওই নিরাপত্তাকর্মীরা ঘটনার কয়েক দিন পরই অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে গেছেন বলে জানিয়েছেন ভবনের বাসিন্দারা। কারাগারে গাড়িচালক ও বাবুর্চি : সালাহ উদ্দিন আহমেদের এপিএস ওসমান গণি, দুজন গাড়িচালক শরিফুল ইসলাম খান ও খোকন মিয়া এবং বাবুর্চি আবদুর রহিদ বর্তমানে কারাবন্দি। সালাহ উদ্দিনের  অবস্থান জানতে তাঁদের আটক করা হয়েছিল। বিস্ফোরক ও নাশকতার মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। অন্যদিকে কয়েক দফায় তাঁদের জামিনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাঁরা মুক্তি পাননি। সালাহ উদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন আগে ব্যক্তিগত এই কর্মীদের আটকের সঙ্গে ঘটনার যোগসূত্র ছিল বলে মনে করেন হাসিনা আহমেদ। কারাবন্দি ওই কর্মীদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতে পারেননি। আইনি প্রচেষ্টা নিয়েও রহস্য : বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা গত মাসে পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। সেখান থেকে ফিরে গণমাধ্যমকে আইনজীবীরা বলেন, ‘পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি, সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আমরা হয়তো ফেরত পাব।’ এ বিষয়ে আছাদুজ্জামান মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি তাঁদের এ ধরনের কোনো আশ্বাস দিইনি। তবে তাঁর সন্ধানে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত আছে।’  আবার সালাহ উদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করতে হাইকোর্টের দেওয়া রুলের রায় পিছিয়েছে তাঁর আইনজীবীর আবেদনেই। গত মাসে এ মামলার রায় ঘোষণার কথা থাকলেও আবেদনকারীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতে বলেন, নতুন কিছু তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য তিনি সময় চান। আদালত তাঁকে সময় দিয়ে পরবর্তী দুই মাস পুলিশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক গত ১৫ মার্চ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাঁচটি প্রতিবেদন ও দুটি পুলিশ ডায়েরি আদালতে উপস্থাপন করেন। সালাহ উদ্দিনের আইনজীবীদের আবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেল এসব প্রতিবেদনের সত্যায়িত অনুলিপিও জমা দেন। আদালতে উপস্থাপন করা পুলিশের প্রতিবেদন অনুসারে, যে বাসা থেকে সালাহ উদ্দিনকে ‘তুলে নেওয়ার’ অভিযোগ করেছে পরিবার, সেখানে খুঁজে এসে রায়হান নামে এক ব্যক্তির অবস্থান ও চলে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় আদালতের নির্দেশ নিয়ে ও পুলিশের মাসিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে কতটা কাজ হবে তা নিয়ে সংশয়ে আছে স্বজনরা। সালাহ উদ্দিন র‌্যাবের কাছে- খালেদা : বিএনপির নিখোঁজ যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ র‌্যাবের কাছে আছে বলে দাবি করেছেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তাঁর কিছু হলে পরিণতি ভালো হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। গতরাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপি-সমর্থক কর আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে খালেদা জিয়া এ কথা বলেন। খালেদা জিয়া বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) সালাহ উদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পূর্ণ হবে। আমরা এখনো তাঁকে পাইনি। সালাহ উদ্দিন র‌্যাবের কাছে আছে।’ তিনি তাঁকে অবিলম্বে তাঁর পরিবারের কাছে অথবা যেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল সেখানে ফেরত দিয়ে যাওয়ার দাবি জানান।

No comments:

Post a Comment