Monday, May 11, 2015

প্রশ্নপত্রের কাঠামো পাল্টাচ্ছে:যুগান্তর

নকল বন্ধে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর ছয় বছরের মাথায় এসএসসি ও এইচএসসির প্রশ্নের কাঠামোতে পরিবর্তন আসছে। উভয় স্তরের অবজেকটিভ পরীক্ষায় ১০ নম্বর করে কমছে। এই ১০ যোগ হবে রচনামূলক প্রশ্নের ক্ষেত্রে। ২০১৭ সালে অনুষ্ঠেয় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে প্রশ্নপত্রের কাঠামো পরিবর্তনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। আগামী বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত
সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা আছে। ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়। বৈঠকের একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, মূলত পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের নকল সরবরাহ বন্ধে এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে নকল বন্ধ এছাড়াও সাব-সেন্টার (ভেন্যু কেন্দ্র) প্রথা বন্ধ এবং নকল সরবরাহকারী শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমাদের কাছে তথ্য আছে ‘কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক পরীক্ষাকালে অনাকাক্সিক্ষত কাজ করছেন। তাদের কেউ কেউ প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলার পর তা নিয়ে বসে পড়েন উত্তর তৈরির জন্য। এরপর সহযোগিতার জন্য তা শিক্ষার্থীদের কাছে দেন। আমরা এমন বেশকিছু শিক্ষককে চিহ্নিত করেছি। এখন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে। এরপর তাদের শাস্তি দেয়া হবে। এরা শিক্ষকসমাজের মান ক্ষুণœ করছেন। তারা শিক্ষক নামের কলংক। তাদের এই পেশায় থাকার অধিকার নেই। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত যুগ্মসচিব (মাধ্যমিক) রুহী রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘পাবলিক পরীক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আজ (রোববার) বৈঠক হয়েছে। আমরা বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে তা চূড়ান্ত করতে ফের বৈঠক হবে। ’ সূত্র জানায়, মূলত নকল সমস্যা সমাধানের জন্য প্রশ্নপত্রের কাঠামোতে পরিবর্তন আর ফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষার সময়সীমা কমানোর প্রস্তাব আসে। এই দুটি দিকে নজর দিতে গিয়ে এসএসসি ও এইচএসসির পাঠ্যবইয়েও সংস্কার আনতে হচ্ছে। বর্তমানে এসএসসি এবং এইচএসসি উভয় স্তরে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু আছে। এই পদ্ধতিতে বর্তমানে বিজ্ঞান বিভাগে রচনামূলক ৪০ এবং অবজেকটিভে ৩৫ এবং ব্যবহারিকে ২৫ নম্বরের পরীক্ষা হচ্ছে। মানবিক ও বিজনেস স্টাডিজে রচনামূলক ৬০ নম্বর এবং অবজেকটিভে ৪০ নম্বরে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। নতুন প্রশ্ন কাঠামোতে বিজ্ঞান বিভাগে রচনামূলকে নম্বর হবে ৫০, অবজেকটিভে ২৫ নম্বরের পরীক্ষা হবে। ব্যবহারিকে বর্তমান নম্বর ঠিক থাকবে। মানবিক ও বিজনেস স্টাডিজে রচনামূলকে ৭০ এবং অবজেকটিভে ৩০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, একাধিক সদস্য অবজেকটিভ প্রশ্ন ২০ নম্বরে করার প্রস্তাব করে বলেন, তাহলে নকল প্রবণতা কমতে পারে। আবার কেউ কেউ অবজেকটিভ একেবারেই তুলে দেয়ার প্রস্তাব করেন। তখন কয়েকজন সদস্য বলেন, এটা করা হলে পাসের হারে প্রভাব পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে পাসের হার কমে যাবে। তখন ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবুবক্কর অবজেকটিভে নম্বর না কমিয়ে রচনামূলক অংশের পরীক্ষা শেষে এবং অবজেকটিভ পরীক্ষা প্রথম ৪০ মিনিটে নেয়ার প্রস্তাব করেন। আলোচনার সূত্র ধরে অন্য বোর্ড চেয়ারম্যান এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও নানা প্রস্তাব দেন। শেষে অবজেকটিভে ১০ নম্বর করে কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। তবে এতেও জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা কমে যেতে পারে বলে দু-একজন মতামত পেশ করেন। বৈঠকের একাধিক সূত্র আরও জানায়, সভাটি ডাকা হয়েছিল মূলত পাবলিক পরীক্ষাকে ঘিরে সংঘটিত নানা অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। এতে মোট ৭টি বিষয় আলোচিত হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রশ্নফাঁস, ফেসবুকেসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসের গুজব সৃষ্টি, ভেন্যু কেন্দ্রে নকল, কেন্দ্রে শিক্ষকদের নকল সরবরাহ, কেন্দ্র বিনিময় প্রথা, দীর্ঘ রুটিনে পরীক্ষা নেয়া ইত্যাদি। এক ব্যক্তির দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একই কেন্দ্রে বসে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগের বিষয়টি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বোর্ড। কারণ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে দেখাদেখি করে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে মানসম্পন্ন না হলেও নকলের সুযোগে ভালো ফল করছে এসব প্রতিষ্ঠান। অনেক সময় এরা বোর্ডের সেরা দশের মধ্যে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করে থাকে। এদিনের সভায় বিষয়টি আলোচনার কথা থাকলেও রহস্যজনক কারণে এ প্রসঙ্গে কোনো কথা হয়নি। এ ব্যাপারে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ যুগান্তরকে বলেন, ‘অবজেকটিভ অংশের উত্তর দেয়া নিয়ে আমরা নানা অভিযোগ পাচ্ছি। এজন্য পরীক্ষার প্রথম ৪০ মিনিটে অবজেকটিভে অংশ নেয়ার পক্ষে অধ্যক্ষরা মত দিয়েছেন। বিষয়টি বৈঠকে উত্থাপনের জন্য আমরা চেয়ারম্যান স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম। কেননা পরীক্ষাটি পরে নেয়ায় ছাত্ররা নিজেরাও যদি বলাবলি করে তাহলে একজন বা দু’জন পরিদর্শকের (শিক্ষক) পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। এতে করে যে ছাত্রের ৪০ পাওয়ার কথা ছিল সে যেমন ৪০ পায়, আবার যার ২০ পাওয়ার কথা, সেও ৪০ পায়। ফলে ভালো ছাত্রটি বঞ্চিত হয়। ড. চন্দ আরও বলেন, ‘অবজেকটিভে নম্বর কমানোর ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটিরও সুপারিশ ছিল। কেননা কিছু দুষ্টু শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান নকলে সহায়তা করেন, যাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হচ্ছিল।’ নাম প্রকাশ না করে একটি বোর্ডের চেয়ারম্যান যুগান্তরকে বলেন, সভায় এর বাইরে পাবলিক পরীক্ষার সময়সীমা কমানোরও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে প্রায় দেড় মাস ধরে এসএসসি আর তিন মাস ধরে চলে এইচএসসি পরীক্ষা। সরকার মনে করছে, দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষা নেয়ায় প্রশ্নফাঁসের সুযোগ থাকছে। এ কারণে কোনো ছুটি ছাড়াই দৈনিক একটি করে পরীক্ষা নেয়া হলে অল্প দিনেই শেষ করা সম্ভব। আর এটি করতে গিয়ে এসএসসি-এইচএসসি বিশেষ করে এইচএসসিতে বিষয়-গুচ্ছ কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হবে। এর ফলে একইগুচ্ছের পরীক্ষা সকাল-বিকাল নিয়ে সময় সাশ্রয় করা হবে। মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ছায়েফউল্লাহ এ ব্যাপারে বলেন, এসব বিষয় আলোচনা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী ১৩ মে ফিরতি বৈঠকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। এদিকে সাধারণত পাঠ্যবই অনুসরণে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এবার পাঠদান পরীক্ষা গ্রহণের সুবিধার্থে পাঠ্যবই রচনা করা হবে। সভায় উপস্থিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, অল্পসময়ে পরীক্ষা শেষ করার লক্ষ্যে বিষয়-গুচ্ছে পরিবর্তন করা হবে। এখন যেমন কোনো শিক্ষার্থী অর্থনীতি ও পৌরনীতি উভয় বিষয় পড়তে পারে। গুচ্ছে পরিবর্তন হলে হয়তো যে কোনো একটি বিষয় পড়ার সুযোগ পাবে ওই শিক্ষার্থী। তবে এটা করতে গিয়ে কিছু বিষয়ের পাঠ্যবইয়ের সংস্কার হবে, যাতে কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিষয় নেয়া থেকে বঞ্চিত হলে সেই সঙ্গে ওই বিষয়ের জ্ঞানবঞ্চিত না হয়, সেটা সমন্বয় করে পাঠ্যবই রচনা করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বোর্ড চেয়ারম্যান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পুরোদমে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়। এর আগে ৫০ নম্বরের অবজেকটিভ প্রশ্ন ছিল। সৃজনশীল পদ্ধতিতে তা অবশ্য কমানো হয়। কিন্তু বোর্ডের সেরা দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ঠাঁই করে নেয়া এবং বাণিজ্যিক স্কুল ও কলেজগুলো তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে পরীক্ষায় নানা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এই ব্যাধি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার এক দৃষ্টান্তে দেখা যায়, ক্যামব্রিয়ান কলেজ ও কিংস কলেজ একই ব্যক্তির মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একই কেন্দ্রে একই বেঞ্চে পরীক্ষা দিচ্ছে। আবার রহস্যজনক কারণে নটর ডেম কলেজে কেন্দ্র দেয়া সত্ত্বেও ভিকারুননিসা সেখানে নিজের ছাত্রীদের পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান। পরে নটর ডেম কলেজকে কেন্দ্রের তালিকা থেকেই বাদ দিতে হয়েছে। এই দুটি বিষয়ই নিশ্চিত করেছেন ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। তারা বলেন, পরীক্ষায় এভাবে দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। তবে আমরা চাই স্বচ্ছভাবে পরীক্ষা হোক। সে প্রচেষ্টা সব সময়ই থাকে।  

No comments:

Post a Comment