Friday, May 8, 2015

প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির তাগিদ:প্রথম অালো

সরকারি ভাতা বা অনুদানে প্রতিবন্ধীদের বাঁচিয়ে রাখা যাবে, তবে এতে তাদের উন্নয়ন হবে না। ভাতার সঙ্গে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা গেলে স্বাবলম্বী হবে প্রতিবন্ধীরা। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধীর জীবনে আসবে পরিবর্তন। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে এমন আটটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রতিনিধিরা ‘প্রতিবন্ধীবান্ধব জাতীয় বাজেট ২০
১৫-১৬’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন। তাঁরা প্রতিবন্ধীদের জন্য বাজেটে সব মন্ত্রণালয়কে বিশেষ বরাদ্দ বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। রাজধানীতে প্রথম আলোর কার্যালয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ও ডিজঅ্যাবিলিটি রাইটস অ্যাডভোকেসি ফান্ডের সহযোগিতায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রথম আলো। এতে সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘গ্রামগঞ্জে অনেক হতদরিদ্র প্রতিবন্ধী আছে, যাদের মা-বাবা কেবল এই ভাতার জন্যই তাদের পরিবারের সঙ্গে রাখে। তাই এটি রেখেই দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান ও স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করব আমরা।’ তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রতিবন্ধীদের ভাতার পরিমাণ ও সংখ্যা বাড়ানো হবে। বাজেটকেন্দ্রিক এ আলোচনায় প্রতিবন্ধীদের অধিকারের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। বক্তারা সরকারের ১৯৬৪ সালের রুলস অব বিজনেস পরিবর্তনের দাবি তোলেন। কারণ এর অজুহাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব দায় চাপানো হচ্ছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে। অন্য মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করাকে বোঝা মনে করছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অনুদাননির্ভরতার বাইরে যেতে হলে শিক্ষা, দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উদ্যোগী করতে হবে।’ তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পে নারী ও পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে তা উল্লেখ থাকে। প্রতিবন্ধীদের জীবনে প্রকল্পটি কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, সেটি উল্লেখ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। জাতীয় তৃণমূল প্রতিবন্ধী সংস্থার সভাপতি আবদুল হাই মণ্ডল বলেন, ‘বাজেটকে প্রতিবন্ধী করে রাখা হয়েছে। কোনো উন্নয়ন নাই। সরকারের একজন প্রতিনিধি আমাদের প্রতিবন্ধী নয়, সুবর্ণ নাগরিক নামে ডাকার কথা বলেছিলেন। আমরা সুবর্ণ নাগরিক হলে বাজেটও সুবর্ণ হতে হবে।’ তিন বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হন খন্দকার জহুরুল আলম। তিনি সেন্টার ফর সার্ভিস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটির নির্বাহী পরিচালক। বললেন, ‘প্রতিবন্ধী বিষয়টি সমাজকল্যাণের মনোপলি বিজনেস বা কাজে পরিণত হয়েছে। আইন, নীতি ও সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে রুলস অব বিজনেসের পরিবর্তন দরকার।’ তিনি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা জানার জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে একটি শুমারি করারও আহ্বান জানান। প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নামের মধ্যেই দায়িত্বের চাইতে কল্যাণের বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নেতিবাচক। রুলস অব বিজনেস পরিবর্তন করতে গেলে সরকারকে বেশ কিছু কাজ করতে হবে।’ প্রতিবন্ধীবিষয়ক মানবাধিকারকর্মী মনসুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ভাতা স্বচ্ছভাবে সব জায়গায় দেওয়া হয় না। দেশের অনেক প্রতিবন্ধী জানেনই না ভাতা আছে। এখানে লেনদেনের ব্যাপার আছে। সরকারের উচিত ভাতা স্বচ্ছ করা।’ বক্তব্যের শুরুতেই তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। ফলে অনেক প্রতিবন্ধীই ভোট দিতে যেতে পারেননি।’ অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন অ্যাকসেস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আলবার্ট মোল্লা। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে দ্বিমুখী পদক্ষেপ হিসেবে বর্তমানে চলমান প্রকল্পে তাদের অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি বিশেষ প্রকল্প নিতে হবে। তিনি সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেন। পরে বিষয়টি বাস্তবায়নে অর্থ প্রতিমন্ত্রী আশ্বাস দেন। প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আশরাফুন্নাহার বলেন, ‘কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হুইলচেয়ারে যাতায়াতের ব্যবস্থা (র্যাম্প) হচ্ছে, তবে প্রতিবন্ধীবান্ধব বাথরুম নেই। আসলে অবকাঠামো আমাদের উপযোগী না হলে আমরা ঘর থেকে বেরোতে পারব না। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের উন্নয়নে অংশীদার হতে চাই, ঘরে বসে টিভি দেখতে চাই না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও শুধু প্রবেশগম্যতার অভাবে তাঁর পড়া হয়নি বলে জানালেন তিনি। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা নিয়ে কথা বলেন ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) প্রোগ্রাম ম্যানেজার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ভাস্কর ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কয়েকজন প্রতিবন্ধীর হাতে বই তুলে দিয়েছেন। তবে সবাই বই পায়নি। এটি দুঃখজনক। মাত্র পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেই সব প্রতিবন্ধী শিশুর হাতে ব্রেইল বই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবন্ধীরা তথ্যপ্রযুক্তির বাইরে থাকলে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে না। মাত্র ১০ কোটি টাকা খরচ করলেই সব ওয়েবসাইট ও ই-সার্ভিসে প্রতিবন্ধীরা প্রবেশাধিকার পেতে পারে।’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ওসমান খালেদ। তিনি সোসাইটি অব দ্য ডেফ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজারসের চেয়ারম্যান। পুরো আলোচনায় তানজিলা তারতুসী তাঁর ইশারা দোভাষী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর মাধ্যমে ওসমান খালেদ ট্রেন ও বাসে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, স্কুল-কলেজে বাকপ্রতিবন্ধীদের পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি নেই। এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সি এম তোফায়েল সামি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। তিনি প্রতিবন্ধী শিশুদের অভিভাবকদের দিকেও নজর দেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। সুইড বাংলাদেশের সভাপতি জওয়াহেরুল ইসলাম একজন ৪০ বছর বয়সী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ের বাবা। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের প্রতিবন্ধীদের নাক, চোখ, মুখ সবই আছে। তবে তাঁদের প্রয়োজনটাই তাঁরা বুঝতে পারেন না। তাই স্নায়বিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে।’ এ ছাড়া ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ বরাদ্দের বিষয়ে গুরুত্ব দেন তিনি। ডিজেবল রিহ্যাবিলিটেশন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা ইয়াসমীন বলেন, ‘কোন প্রতিবন্ধীর জন্য ভাতা প্রয়োজন আর কার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা যাচাই করতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদের শুধু শিক্ষা উপবৃত্তি দিলেই হবে না, সুনির্দিষ্ট কৌশলও নিতে হবে।’ বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বদিউল আলম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিচালিত সংগঠনগুলোর জন্য বিশেষ বরাদ্দের দাবি জানান। সমাপনী বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে সচেতন। চিন্তায়-চেতনায় ঘাটতি নেই। বাজেটে ঘাটতি আছে।’ তিনি জানান, আগামী বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ বাড়ছে। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীবান্ধব করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

No comments:

Post a Comment