Friday, May 22, 2015

বাড়ছে পারিবারিক খুনোখুনি আত্মহনন:কালের কন্ঠ

চার বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেন ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন ও দেলোয়ারা বেগম। বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় একে-অপরকে অবিশ্বাস করতে থাকেন। শুরু হয় কলহ। বছরখানেক আগে রাজধানীর দক্ষিণ কাফরুলের বাসায় তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ইসমাইল হোসেন স্ত্রী দেলোয়ারাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। এরপর নিজেও ফ্যানে ঝুলে আত্মাহুতি দেন। এই দম্পতির দুই সন্তান দোয়েল ও আনন্দ এখনো জানে না তাদের মা-বাবা কোথায়। তাদের নিয়ে স্বজনরাও আছে বেকায়দায়। মামলা
র তদন্ত কর্মকর্তা কাফরুল থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) অনিমেষ চন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, তদন্তে বেরিয়েছে স্ত্রী মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতেন বেশি। এ কারণে ইসমাইল সন্দেহ করতেন তাঁর স্ত্রী অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। এরই জের ধরে ঘটে গেছে ট্র্যাজেডি। চট্টগ্রামের প্রবাসী আবদুল হাকিমের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার। প্রথম স্ত্রী রোজী আক্তার। স্বামীর ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে দুই সতিনের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। সম্প্রতি সতিনকে নিজের বাসায় দাওয়াত করে ডেকে নিয়ে যান রোজী। এরপর তাঁর বাসায় হয় 'ডাকাতি'। ডাকাতরা বাসা থেকে কোনো কিছু লুট না করলেও গলা কেটে হত্যা করে শারমিনকে। গত বৃহস্পতিবার নগরের পাঁচলাইশ থানার মির্জারপুল এলাকার একটি ফ্ল্যাটে এই ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে আসে, ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে সতিনকে হত্যা করিয়ে ডাকাতির নাটক সাজান রোজী নিজেই। কক্সবাজারের চকরিয়ার বদরখালি ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়ার আব্দুল গণি-ফাতেমা বেগম দম্পতির তিন মেয়ে, এক ছেলে। গত শুক্রবার তাঁদের বাসা থেকে তিন মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা (৯), শিরোজান্নাত শিউলি (৯) ও তহুরা জান্নাতের (২০) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় ফাতেমা বেগম বাসায় ছিলেন না। আর তাঁদের একমাত্র ছেলে রিফাত (১৪) ছিল নানাবাড়িতে। নিহত তিন মেয়ের বাবা গণিকে গত সোমবার চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই দিনই তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে নিজের মেয়েদের জবাই করার কথা স্বীকার করেন। আব্দুল গণি দাবি করেন, স্ত্রী ফাতেমার অনৈতিক সম্পর্কের কারণে চরম মানসিক বিপর্যয়ে পড়ে তিনি নিজের মেয়েদের হত্যা করেছেন। তবে ফাতেমাও গণির বিরুদ্ধে পাল্টা পরকীয়ায় জড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন। গত বছরের ৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় মা বিনা বেগম ও মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায় তাঁর এক বছরের ছেলে সামিরের লাশ উদ্ধার করা হয়। আর সাত বছরের মেয়ে সামিরাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানান, স্বামীর সঙ্গে কলহের জের ধরে দিশেহারা হয়ে বিনা আত্মহত্যা করার আগে হত্যা করেন ছেলেকে। মেয়েটাকেও মারধর করেন বেদম। প্রায় প্রতিদিনই দেশে এমন মর্মস্পর্শী অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধ। এসব ঘটনার প্রধান শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু। অপরাধ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক বছরে দাম্পত্য কলহ, নির্যাতন, অনৈতিক সম্পর্ক এবং বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। সেইসঙ্গে ঘটছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের ১৫ মে পর্যন্ত সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে এক লাখ ১৮ হাজার ১৯২টি। আর হত্যা মামলা হয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পারিবারিক কলহের জের ধরে দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৩ জন খুন হচ্ছে। প্রতিদিন আত্মহত্যা করছে ২৯ জন। আর গড়ে প্রতিদিন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রায় ৫৭ জন নারী। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের ১৫ মে পর্যন্ত সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে এক লাখ ১৮ হাজার ১৯২টি। এ সময় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১০ হাজারের বেশি নারী, শিশু ও পুরুষ। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সামাজিক ও পারিবারিক সহিংসতার কারণে ২০১৩ সালে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৯ হাজার ৬০১টি মামলা হয়। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ২৯১। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ৭৫২। ২০১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ৩৮৯। ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ৯৪৭। গত সোমবার রাজধানীর হাজারীবাগে ঘটেছে এমনই একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা। পুলিশ জানিয়েছে, পারিবারিক কলহের জের ধরে স্ত্রী ইফাত আরাকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর স্বামী মোহাম্মদ রাসেল গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। গত রবিবার রাতে সিলেটের সওদাগরটুলা এলাকায় স্থানীয় তবলিগ জামাতের আমির ইব্রাহিম আবু খলিলকে জবাই করে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, দাম্পত্য কলহের জের ধরে স্ত্রী ফাতেহা বেগমই খলিলকে হত্যা করেন। গত বুুধবার রাজধানীর পল্লবীর একটি ফ্ল্যাট থেকে সুইটি বেগম ও তাঁর মামাশ্বশুর আমিনুল ইসলামের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকারীদের হামলায় আহত হয় নিহত সুইটির পাঁচ বছরের ছেলে সাদও। নিহতের স্বামী ডেসকোর প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম দাবি করেন, ব্যবসায়িক বিরোধ বা চাঁদা না দেওয়ার কারণে তাঁর স্ত্রী ও মামাকে খুন করা হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, ঘটনাটি রহস্যজনক। এ ঘটনায়ও পারিবারিক বিরোধের ক্লু খুঁজছেন তদন্তকারীরা। হত্যা মামলার বাদী জাহিদুল ইসলামকেই সন্দেহের তালিকায় রেখেছে পুলিশ। গত বছরের ১৩ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরে সালাহউদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীকে হত্যার পর থানায় ফোন করে খবর দেন তাঁর স্ত্রী লাবনী আক্তার। পুলিশ লাবনীকে গ্রেপ্তার করে। তদন্তকারীরা জানান, গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে স্ত্রী তাঁর স্বামীকে হত্যা করেন। সাদিয়া (৬) ও ছোঁয়া (৪) নামে দুই সন্তান আছে তাঁদের। নিহত সালাহউদ্দিনের ভগ্নিপতি নাজমুল হোসেন বলেন, 'হঠাৎ করেই ওই ঘটনা জানাজানির পর লাবনী ও বাসার লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায়ও আমরা ফয়সালার জন্য বসেছিলাম। কিন্তু লাবনী তা মানেনি। এমন ঘটনা ঘটবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।' গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীর পূবালী এলাকার ৩২৯/১/এ নম্বর বাড়িতে গৃহবধূ সুরভী আক্তারকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন তাঁর স্বামী সাজ্জাতুল ইসলাম রাসেল। পরদিন থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ঘটনার মাত্র ১৫ দিন আগে পৃথিবীর আলো দেখে তাঁদের মেয়ে নরীম। অরিন নামে তাঁদের চার বছরের আরেকটি ছেলে আছে। নিহত সুরভীর ভাই শামসুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, রাসেল মাদকাসক্ত ছিলেন। আর এ কারণেই এই করুণ পরিণতি। যৌতুকের টাকার জন্য প্রায়ই স্ত্রীকে নির্যাতন করত রাসেল। এ রকম একের পর এক ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সমাজবিজ্ঞানী, মনস্তত্ত্ববিদ, অপরাধ বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, খুনের পাশাপাশি আত্মহননের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তেমনি ফুটে উঠেছে মানুষের অসহিষ্ণুতার প্রতিচ্ছবি। তাঁদের অভিমত, পারিবারিক বন্ধন শিথিল ও দুর্বল হওয়া এবং আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের কারণেই এসব ঘটনা বাড়ছে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবেই পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে যান্ত্রিক জীবনে বাড়ছে অস্থিরতা ও হতাশা। অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে মানুষ। শহরাঞ্চল ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে পারিবারিক অপরাধের মাত্রা বেশি। এসব ক্ষেত্রে টেলিভিশন সিরিয়ালের বিকৃত গল্প, ইন্টারনেট ও সামাজিক ওয়েবসাইটের নেতিবাচক প্রভাবও দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, সামাজিক অপরাধ রোধ করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে। কমিউনিটি পুলিশের কার্যক্রম আরো বাড়ানো হবে। তিনি আরো বলেন, আত্মহত্যার নেপথ্যে কারো প্ররোচনা বা অন্য কোনো কারণ থাকে কি না, তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হয়। তবে আমাদের তদন্তে দেখা গেছে, পারিবারিক কলহ, সাংসারিক অশান্তি, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, পরকীয়া ও মাদকাসক্তির জের ধরে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক জিনাত হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণেই এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পরকীয়া সম্পর্ক, মাদকাসক্তি, মানসিক দূরত্ব হত্যা বা আত্মহত্যার মতো অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন, অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, বিকৃত টিভি সিরিয়াল এবং সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব।' অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, 'অস্থির অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে হবে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী- সবার মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এতে অনেক সমস্যারই সামাজিক সমাধান সম্ভব হবে।' মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক ওমর ফারুক বলেন, 'মূলত সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ের সংহতি হ্রাস পাওয়ার কারণে এ ধরনের অপরাধ ঘটছে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, অনৈতিক সম্পর্ক, চাহিদার বৈচিত্র্যতা থেকেই সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। সামাজিক অপরাধের এই নিয়ামকগুলো প্রতিরোধে প্রয়োজন পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা এবং সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করা।' পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে দুর্বল আইনি ব্যবস্থার কারণেই সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ২০১০ সালে 'পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, ২০১০' নামে একটি আইন পাস করা হয়েছে। কিন্তু আইনটির যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। আবার আইনটিতে সাজা খুবই কম। এই আইনে কেউ অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। সাজা ভোগ করার পর আসামি যদি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে তাহলে তার দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। এ প্রসঙ্গে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, যেভাবে পারিবারিক অশান্তি হচ্ছে তাতে এই আইনের ধারা পরিবর্তন করতে হবে। অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। তাহলে সামাজিক অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, অপরাধ দমন করার জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি অপরাধ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, অপরাধী সম্পর্কে সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একজন মা বা বাবা যখন তার সন্তানকে খুন করে তখন সেটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। একটা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তার যথাযথ তদন্ত হতে হবে। বিচারে দাঁড় করাতে হবে অভিযুক্তকে।

No comments:

Post a Comment