Monday, May 18, 2015

করের পরিমাণ নয় আওতা বাড়ান:প্রথম অালো

আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে করের পরিমাণ না বাড়িয়ে এর আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ী, সাবেক সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদেরা (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট)। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর সভাকক্ষে প্রথম আলো ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত ‘২০১৫-১৬ প্রাক-বাজেট আলোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকব
র আলি খান বলেন, ‘দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। উন্নয়নটা সবাই দেখছি আর দেখাচ্ছি। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেটা কেউ দেখছি না। রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে এসব সমস্যা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।’ উন্নয়নের সমস্যার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আকবর আলি খান বলেন, ‘গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে গুলশান থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত আসতে আমার সময় লেগেছে ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। অর্থাৎ আমি উন্নয়নের ভুক্তভোগী।’ সরবরাহকারী ঋণ (সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট) নিয়ে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সমালোচনা করে আকবর আলি খান বলেন, ‘সারা বিশ্বে অচল হয়ে পড়া এ ব্যবস্থা আমাদের দেশে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সচল করা হয়েছে। এর ফলে এ ঋণের বিপরীতে চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। দৃশ্যত এ ধরনের ঋণে সুদহার কম, কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে ঋণদাতা দেশের কাছ থেকে পণ্য কিনতে হয়। সে ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করা হয় বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে। ফলে কার্যত এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়।’ আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায় এবং উন্নয়ন ব্যয়ের (এডিপি) যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত এর কোনোটিই অর্জিত হবে না বলে আগাম মন্তব্য করেন আকবর আলি খান। আইসিএবির সভাপতি মসিহ্ মালিক চৌধুরী আলোচনার সূত্রপাত করে বলেন, দেশে মাত্র ১০ লাখ মানুষ কর দেয়, এটা সত্যিই নিরাশাজনক। তিনি বলেন, ‘ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু আমরা এ লক্ষ্য অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারিনি। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যে বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে তা অর্জন হবে কি না এ নিয়ে সংশয় আছে।’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, প্রতিবছর বাজেটের মাধ্যমে বিপুল অর্থ খরচ করা হচ্ছে, কিন্তু তার কতটা জনগণের কল্যাণে যাচ্ছে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। শিক্ষা খাতে প্রতিবছর যে অর্থ ব্যয় হয়, তার একটি বড় অংশই যাচ্ছে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পেছনে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর কখনো কোনো ধরনের মূল্যায়ন করা হয়নি। সাবেক এই সচিব বলেন, ‘উচ্চাভিলাষী বাজেট করেন, উচ্চাভিলাষী এডিপি করেন, উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেন। কিন্তু সেটা যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয়। বারবার যেন সংশোধন করতে না হয়।’ ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, আয়করের মূল চরিত্রটিই এখন নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর আয়ের ওপর কর হয় না। বর্তমান পদ্ধতিতে ভোক্তারাই আয়কর দিয়ে থাকেন। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, সরকারিভাবে অনেক অর্থ ব্যয় হচ্ছে, যা থেকে কোনো সেবা আসছে না। যেমন ট্রাফিক বাতির জন্য অর্থ খরচ হচ্ছে, আবার সার্জেন্ট হাত নেড়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি বলেন, করদাতাদের ৮৭ শতাংশই হলো সাধারণ করদাতা। অথচ, যত আইন করা হচ্ছে তা গিয়ে পড়ছে এই করদাতাদের ওপর। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের এই চেয়ারম্যান বলেন, বারবার এই সুযোগ দেওয়ার ফলে এর কার্যকারিতা এখন শেষ হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতিতে যে সক্ষমতা বা সম্পদ রয়েছে সেই অনুযায়ী সরকার যথাযথ সম্পদ আহরণ করতে পারছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আইসিএবির সহসভাপতি এ এফ নেছার উদ্দিন প্রশ্ন রাখেন, ‘৩৫ শতাংশ (করপোরেট) কর দিয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলো কেন এ দেশে আসবে?’ তিনি বলেন, জোরজবরদস্তি করে কর আদায় করা সঠিক কোনো পন্থা নয়। করের হার কমিয়ে বেশি মানুষকে করের আওতায় আনা প্রয়োজন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি) ২০০৯ সালে শুরু হয়। কিন্তু কিছুই হয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার বিদেশ থেকে ঋণ আনছে। কিন্তু ঋণ না এনে ওই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ তো আনা যায়।’ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কর আদায় বাড়ানো এবং করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। নতুন পে-স্কেল প্রসঙ্গে আইসিএবির সাবেক সভাপতি আব্বাস উদ্দিন খান বলেন, পে-স্কেল অনুযায়ী বেতন দিতে হলে তা আদায় করা রাজস্ব থেকে সংস্থান করা সম্ভব হবে না। সরকারকে এ জন্য ঋণ নিতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। ২০-২২ লাখ সরকারি কর্মচারীর বেতন বাড়াতে গিয়ে সারা দেশের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হবে। আইসিএবির সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম বলেন, সরকারি প্রকল্পগুলো দক্ষ লোক দিয়ে নিরীক্ষা করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম বলেন, ভয়-ভীতি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে কখনো বিনিয়োগ হয় না। বিনিয়োগের জন্য নিরাপত্তা লাগবেই। ব্যবসায়ীদের আস্থা না ফিরলে দেশে বিনিয়োগ হবে না। দেশে বিনিয়োগ না হলে ৭-৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধিও হবে না। তামাক ও টেলিযোগাযোগ খাত থেকে সরকার আরও রাজস্ব আদায় করতে পারে বলে মত দেন তিনি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) আহসান হাবীব দেশে একটি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে আগামী বাজেটে এর জন্য বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেন। আইসিএবির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম শুধু রাস্তা নির্মাণ না করে শিক্ষা-অবকাঠামোতে জোর দেওয়ার আহ্বান জানান। আইসিএবির সহসভাপতি কামরুল আবেদিন বলেন, সরকার-নির্ধারিত মূল্যে জমির নিবন্ধন হয়, বাজারমূল্যে না। কালোটাকার মালিকেরা এর সুযোগ নিচ্ছেন। আবার সাদাটাকার মালিকেরা বাজারমূল্যে কিনে মৌজামূল্যে নিবন্ধন করায় তাঁদের হাতে অস্তিত্বহীন অর্থের সৃষ্টি হয়। তাই বাজারমূল্যের সঙ্গে মিল রেখে মৌজামূল্য নির্ধারণ এবং করহার কমানোর মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সভায় সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘পত্রিকা চালানোর জন্য নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে আমাদের ৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। আমরা শূন্য শুল্ক করার দাবি জানিয়েছি। আবার এমনিতে সংবাদপত্রের ওপর মূসক আরোপ নেই। কিন্তু যখন আমরা নিউজপ্রিন্ট আমদানি করি তখন ১৫ শতাংশ মূসক কেটে রাখা হয়। এই বিষয়টিও বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।’ সভার সঞ্চালক আইসিএবির সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির করের আওতা বাড়াতে গিয়ে যেন হয়রানি না বাড়ে, সেদিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান।

No comments:

Post a Comment