Sunday, May 3, 2015

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বেহাল বিটিভি চলছে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি:কালের কন্ঠ

রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দর্শকরা। কারণ একসময়ের জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানটি এখন দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচারণায় ব্যর্থ হচ্ছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এ সুযোগে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন বিভাগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনায় এসব তথ্য উঠে
এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ তদন্ত করে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে সাব-কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এর আগে গত ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিটিভিতে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা এ আলোচনায় অংশ নেন। তাঁরা বিটিভির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে এর আগে গঠিত সাব-কমিটিকে এ-সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বৈঠক থেকে এ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। বিটিভির সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তদন্তে গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ কে এম রহমতুল্লাহকে আহ্বায়ক এবং সুকুমার রঞ্জন ঘোষ ও তারানা হালিমকে সদস্য করে একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও ১৯ মার্চের বৈঠকে সাব-কমিটির মেয়াদ আরো দুই মাস বাড়ানো হয়। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে জানানো হয়, সাব-কমিটি ইতিমধ্যে তদন্তকাজ শুরু করেছে। গণমাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে আমলাদের বিটিভিতে মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে সংসদীয় কমিটির আলোচনায় উঠে আসে। সেখানে জানানো হয়, সর্বশেষ মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল মান্নান। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অনুষ্ঠান বিভাগের উপমহাপরিচালক বাহারউদ্দিন খেলনের, যিনি সংবাদ বিভাগেও প্রভাব খাটান। ফলে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম হয়েও সরকারের সাফল্য বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। কমিটির বৈঠকে সরকারি দলের সদস্যরা বিটিভিতে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়েও সমালোচনা করেন। বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই দর্শক আকর্ষণে ব্যর্থ বলে তাঁরা দাবি করেন। তাঁরা জানান, এ বিভাগে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মও চলে। অনভিজ্ঞ সত্ত্বেও কর্মকর্তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে অনুষ্ঠান তৈরি করা হয়। একটি নাটকে ১০ জন কলাকুশলী লাগলে সেখানে ১৫ জনের বিল তোলা হয়। বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠান পুরনো ফুটেজ দিয়ে চালানো হলেও নতুন ফুটেজের জন্য বিল তোলা হয়। আবার অবৈধ অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠান তৈরির অভিযোগও রয়েছে। গত বছরের ২৮ জুলাই বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে পরিচিত মুসা বিন শমসেরকে 'কৃতী বাঙালি' হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। কমিটি-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিয়োগবিধির ত্রুটির কারণে বিটিভিতে শিক্ষিত ও যোগ্য কর্মকর্তারা নিয়োগ পাচ্ছেন না। সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, ১৬৯ কর্মকর্তার মধ্যে কমপক্ষে ১৫ জন স্নাতক পাস করেননি। আর বিটিভির অনুমোদিত এক হাজার ৬৬৭টি পদের মধ্যে ৪০৪টি পদ শূন্য রয়েছে, যার মধ্যে ১৫২টি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদ। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া দলবাজ কর্মকর্তারা এখনো বহাল আছেন। ভ্রান্তনীতি ও যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে বিটিভিতে পেশাদার সাংবাদিকদের যুক্ত করা যায়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে চরম অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা চলছে। সংসদীয় কমিটির কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, বৈঠকে বিটিভির দুই কর্মকর্তার ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বিষয়টি উত্থাপন করেন কমিটির সদস্য মৃণাল কান্তি দাস। তিনি বিটিভির সার্বিক কার্যক্রমের সমালোচনার পাশাপাশি মহাপরিচালক ও উপমহাপরিচালকের দ্বন্দ্বে বিটিভি ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলেও দাবি করেন। কমিটির আরেক সদস্য তারানা হালিম বলেন, মহাপরিচালককে উপেক্ষা করে একজন কর্মকর্তা বিটিভিতে আধিপত্য বিস্তার করেছেন। দলের নাম ভাঙিয়ে তিনি সবার ওপর দাপট দেখান। সরকারি দলের কেউ কেউ তিন-চারজন নিয়ে মিছিল করে তা প্রচারণার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন, বিটিভিতে তা প্রচারিতও হয়। এ ধরনের খবর প্রচারে বিটিভি ও সরকারের মান ক্ষুণ্ন হয়। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে বলেও তিনি প্রস্তাব করেন। বৈঠকে বিটিভির অনুষ্ঠানের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আরেক সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল। অনুষ্ঠানের মান উন্নয়ন ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে তিনি বিস্তারিত তথ্য জানতে চান। কমিটির সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে বৈঠকে উপস্থিত বিটিভির মহাপরিচালক আবদুল মান্নান বলেন, তিনি যোগ দেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজে শৃঙ্খলার অভাব ছিল, বর্তমানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এ অবস্থায় বিটিভিতে অনিয়ম রয়েছে বলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খবর ছড়ানো হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত তথ্যসচিব বিশৃঙ্খলার বিষয়টিকে দুঃখজনক অভিহিত করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।

No comments:

Post a Comment