বাজার যাচাই ছাড়াই ৪০০ কোটি টাকার যন্ত্র কিনেছে সাতটি সরকারি হাসপাতাল। এমনকি যে ধরনের বা যে মানের যন্ত্রপাতি দেওয়ার কথা ছিল, তা-ও দেয়নি ঠিকাদার। যন্ত্রপাতি কেনা ও সরবরাহে এই নয়ছয় করার পরও ঠিকাদার প্রাপ্যতার বেশি টাকা তুলে নিয়ে গেছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে মাত্র এক অর্থবছরেই (২০১৩-১৪) এসব দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেনাকাটায় অনি
য়মের এসব অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)। এর মধ্যে শুধু ৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতালেই একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র জমা দিয়ে ৩০০ কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, যে সাত হাসপাতালে ৪০০ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না, তার চারটি হাসপাতালে কেনাকাটায় অনিয়মের জন্য দায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক এ বি এম আবদুল হান্নান ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পরিচালকেরা। উল্লেখ্য, এ বি এম আবদুল হান্নানের বিরুদ্ধে কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল ২০০৯-১০ অর্থবছরেও। তিনি তখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঠিকাদারদের যোগসাজশে দুর্নীতি হয়েছে দরপত্র থেকে কেনাকাটা, সরবরাহ থেকে বিল দেওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায়। এমনকি এসব হাসপাতালের ওষুধ কেনা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগেও বড় দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল; শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল; জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু); দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল; শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল; কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে আর্থিক অনিয়ম পাওয়া যায়। এর মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের-ই-বাংলা ও দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং টাঙ্গাইলের ২৫০ শয্যা হাসপাতালের কেনাকাটায় এ বি এম আবদুল হান্নানের সরাসরি দায় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। আর প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, মুগদা হাসপাতালের অনিয়মের সঙ্গেও তাঁর দায় রয়েছে। তবে আবদুল হান্নান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘কোনো কেনাকাটার সঙ্গে আমার সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘অডিট আপত্তি চলমান প্রক্রিয়া। আপত্তি উঠেছে। নিষ্পত্তি হবে।’ দুর্নীতিতে শীর্ষে মুগদা হাসপাতাল: দরপত্র হয়েছে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে, কাজও পেয়েছে সর্বনিম্ন দরদাতা। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে ঘটে গেছে বড় দুর্নীতি। নিরীক্ষক দল কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে পায়, প্রকৃতপক্ষে দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল একই ব্যক্তির মালিকানাধীন। একই ব্যক্তি আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানের নামে জামানতের টাকা জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রক্রিয়ায় ৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আঁতাতে ৩০০ কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে। কোন কোন কর্মকর্তার কারণে সরকারের এই বিপুল টাকা ক্ষতি হয়েছে, তা খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনটি প্যাকেজে ও পাঁচটি লটে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিল মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে ফিউচার ট্রেড, জিইএস অ্যান্ড ট্রেডিং, থিÊআই, আরডেন্ট সিস্টেম, বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল, মার্কেট ল্যাব, মেড ই কুইপ এবং ইনফরমড টেকনোলজি দরপত্র কেনে। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি যোগ্য ঘোষিত হয়। দরপত্র জমা দেওয়ার কাউন্টার ছিল দুটি, একটি মুগদা জেনারেল হাসপাতালে, অন্যটি হেলথ সিস্টেম ম্যানেজমেন্টের লাইন ডিরেক্টরের কার্যালয়ে। কোনো দরপত্রই মুগদা হাসপাতালে জমা পড়েনি। হেলথ সিস্টেম ম্যানেজমেন্টের লাইন ডিরেক্টর আবদুল হান্নান। শেষ পর্যন্ত কাজটি পায় ফিউচার ট্রেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যার মালিক দরদাতা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোরও মালিক। মুগদা জেনারেল হাসপাতাল নিশ্চিত করেছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির মালিক নিশাত ফারজানা। তিনি স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত মোতাজজেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর স্ত্রী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রায় সব কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর সখ্য আছে। এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। এসএমএস দেওয়া হলেও জবাব মেলেনি। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের দায়িত্বশীল কমপক্ষে তিনটি সূত্র বলেছে, কোন দেশের কী যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে হাসপাতালের গুদাম কর্মকর্তারাও জানেন না। নিয়ম অনুযায়ী প্রশাসনিক কর্মকর্তার কেনাকাটার বিষয়টি জানার কথা, আর যন্ত্রপাতি বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব গুদাম কর্মকর্তার। এঁরা সবাই অন্ধকারে ছিলেন। দুদক মুগদা হাসপাতালের ১১০ কোটি টাকার অনিয়ম তদন্ত করে দেখছে। জানতে চাইলে ৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মো. মুস্তাফিজুর রহমান মিয়া বলেছেন, ‘আমার জানামতে আমার হাসপাতালে বড় ধরনের কোনো অনিয়ম হয়নি। আমি নিরীক্ষা প্রতিবেদনের জবাব দিয়েছি। দুদককেও কাগজপত্র দিয়েছি।’ এর বাইরে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল হেমাটোলোজি ল্যাব অটোমেশনের কাজেও নিয়মের বাইরে গিয়ে ১০ কোটি ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছে। ল্যাব অটোমেশনে তিনটি যন্ত্রাংশের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ওই টাকা দেওয়া হলেও নিরীক্ষক পরিদর্শনে গিয়ে তৃতীয় যন্ত্রাংশটি খুঁজে পাননি। বেশি দামে যন্ত্রপাতি কিনেছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল; পঙ্গু হাসপাতালও তাই। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য ৩৪টি যন্ত্রপাতি কেনার দরপত্র আহ্বান করেছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল প্রতিটি যন্ত্রের জন্য দর পেয়েছে একটি করে। কেবল এএসএল ও আইম্যাক্স প্লাস একই ধরনের ১৫টি যন্ত্রের জন্য দাম কোট করেছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান একই ব্যক্তির। কেনাকাটায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল খরচ করেছে ২৭ কোটি ৬৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৫০ টাকা। এএসএল ও আইম্যাক্স প্লাসের স্বত্বাধিকারী আফতাব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমি লাভ করি। কিন্তু বেশি দামে যন্ত্র বিক্রি করি না। এ ছাড়া আমার দেওয়া যন্ত্র নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই।’ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি আঁতাতের বিষয়টি বুঝতে পারেনি, জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক এ কে এম মুজিবুর রহমান বলেন, ‘অডিট আপত্তির কপিতে যা আছে তা-ই লিখে দেন।’ ওই একই হাসপাতালে হিসাব ছাড়া ঠিকাদারকে প্রায় দেড় কোটি টাকা দিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। কেনাকাটায় স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম–১: শুধু মুগদা হাসপাতালেই নানা প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র জমা দিয়ে ৩০০ কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) কার্যাদেশ পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে তৌফিকা এনার্জি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আমদানি করা যন্ত্রপাতি কীভাবে এত অল্প সময়ে সরবরাহ করল প্রতিষ্ঠানটি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তৌফিকাকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ১৪টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র কিনলেও দুটি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ঘোষণা করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। এদের একটি তৌফিকা এনার্জি লিমিটেড, অন্যটি তৌফিকা ইঞ্জিনিয়ারিং। দুটি ছিল তৌফিকা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। অডিট আপত্তির জবাবে পঙ্গু হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক মো. হামিদুল হক খন্দকার কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগেও অস্বচ্ছতা: ৫০০ শয্যার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতাকর্মী সংগ্রহের জন্য দরপত্র আহ্বান করে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। ১১টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র কিনলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবাইকে অযোগ্য ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আবারও দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২ কোটি ৩৭ লাখ ৩৯ হাজার ৮২ টাকার বিনিময়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী সরবরাহে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ট্রাস্ট সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিকস সার্ভিসেস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে। নিরীক্ষকেরা বাতিল হয়ে যাওয়া ১১টি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র খতিয়ে দেখেন, গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস দরপত্রের সব শর্তই পূরণ করেছিল। তাদের দরও ছিল ট্রাস্টের চেয়ে ২৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা কম। কাগজপত্রে দেখা গেছে, ট্রাস্টকে কাজ পাইয়ে দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তিতে নতুন করে একটি শর্ত জুড়ে দেয়। শর্তটি ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির সেনানিবাসে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ওই সময় হাসপাতালটির পরিচালক ছিলেন এ কে এম নাসিরউদ্দিন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অডিট মনে করছে, অন্য প্রতিষ্ঠান সব শর্ত পূরণ করেছে। আমরা মনে করছি, অন্য প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণ করেনি।’ অভিযোগ আরও: বরিশালে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ল্যাসিক ও ফ্যাকো মেশিন সরবরাহের ক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হয়েছিল, অত্যাধুনিক ও ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসপি ও মেসার্স আহসান ব্রাদার্স—কেউ শর্ত পূরণ করেনি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুটোই অযোগ্য প্রতিষ্ঠান। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের যন্ত্রপাতি কেনার বিল ঢাকা থেকে পরিশোধ করা হয়েছে। এটিকে গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। এর আগের অর্থবছরেও একই ঘটনা ঘটলে স্বাস্থ্য বিভাগ মুচলেকা দিয়েছিল যে এরপর থেকে যেখানে কাজ হবে, সেখানকার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা টাকা পরিশোধ করবেন। গোপালগঞ্জ থেকে কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওষুধ পাঠানোর কথা বলা হলেও সে ওষুধ চুরি যাওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন নিরীক্ষকেরা।
No comments:
Post a Comment