শুকনো করতোয়া পেরিয়ে ধাক্কামারা মোড় হয়ে কিছুদূর যেতেই জনে জনে শুনতে পাওয়া যায় দীর্ঘ ৬৮ বছরের ধাক্কা খাওয়ার বহুমুখী গল্প। পঞ্চগড়ে ঢাকা-তেঁতুলিয়া মহাসড়ক এফোঁড়-ওফোঁড় করে রাখা জনপদ পুঁটিমারী ছিটমহল। এটি এত দিন ছিল না বাংলা, না ভারত। চারদিকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরেই ৬৮ বছরের অন্য রকম পরাধীনতায় বন্দি থাকতে হয় এখানকার মানুষকে। এখানে মিথ্যায় ভর করে পরিচয় ও জীবনযাপনের পাশাপাশি চলে লুকোচুরি
র খেলা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেড়ে ওঠে কাগজ-কলমের ঠিকানাবিহীন ভিন্ন রকম ঠিকানায়। অবশেষে শেকল ভাঙার সুর বইছে চার-পাঁচ দিন ধরে। ছিটমহলবাসী মনে করছে শেষ হয়ে এলো মিথ্যার দিন। সবই এখন হবে সত্যি সত্যি। তবে এ আনন্দ সুরের মধ্যেই ঢুকে পড়েছে আতঙ্ক আর আবারও ধাক্কা খাওয়ার ভয়। এবারের ভয় আগের মতো দ্বিরাষ্ট্রীয় নয়, বরং স্থানীয় ও আশপাশের প্রভাবশালী জোতদার কিংবা রাজনৈতিক বলে বলীয়ান গোষ্ঠীর। ভয়- নতুন করে পেতে যাওয়া বাপ-দাদার আমলের পুরনো ভিটেমাটি, সহায়-সম্পত্তিটুকু হারানোর কিংবা খরিদ সূত্রে প্রাপ্ত জমির মালিকানা হাতছাড়া হওয়ার। যদিও পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ ছিটমহলবাসীর আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ছিটমহলের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। তাদের যেকোনো প্রয়োজনে সহযোগিতা দেওয়া হবে। কোনো অন্যায়-অপ্রীতিকর কিছু ঘটতে দেওয়া হবে না। ফলে ছিটমহলবাসীকে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। বাংলাদেশ-ভারত ৫৯ নম্বর পুঁটিমারী ছিটমহল নাগরিক কমিটির সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে হবিবর বলেন, 'ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার আগে আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন কোচবিহার মহারাজার প্রজা। আর সেই প্রজাস্বত্বের দালিলিক ভিত্তিতেই আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই জনপদে আছি। এই পুঁটিমারীতে প্রায় ৩০-৩২টি পরিবার এমন আদিবাসিন্দা। পাশাপাশি আমাদের কাছ থেকে পরে মৌখিক বা সাদা কাগজে চুক্তিপত্রের মাধ্যমে এখানে অনেক জমিজমা বেচাকেনা হয়েছে। এমনভাবে এখানে এখন পর্যন্ত আরো প্রায় ৫৫-৬০টি পরিবার জমির মালিকানা পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারতের প্রচলিত আইনে এখানে কারো জমির বৈধতা নেই। ফলে এখন এই ছিটমহল বাংলাদেশের অন্তর্গত হওয়ায় অনেকেই যেমন আইনি জটিলতার শিকার হতে পারে, তেমনি আশপাশের একশ্রেণির প্রভাবশালী মহল তৎপর হয়ে উঠেছে এই এলাকার জমির দখল নিতে। এতে করে ছিটমহলবাসীর অনেকের মধ্যেই আতঙ্ক ভর করেছে উচ্ছেদের। বড় কোনো কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তৎপরতায়ও এখানে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। তবে এমন আতঙ্ক দূর করতে তাৎক্ষণিক এক উদ্যোগের খবর জানিয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যেই ৯ মে পঞ্চগড় জেলার বোদা থানার ওসি আর পার্শ্ববর্তী ময়মানদীঘি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের তৎপরতায় একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে পুঁটিমারী ছিটমহল নাগরিক কমিটির ১১ নেতাকে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আগে এখানে কোনো থানা পুলিশ বা প্রশাসনের কেউ কখনো প্রবেশ না করলেও কদিন ধরে পুলিশ নিয়মিত টহল দিতে শুরু করেছে। আতঙ্ক আর উদ্বেগের কথার পাশাপাশি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার কথা বলতে বলতে চোখের পানি ফেলেন মুক্তিযোদ্ধা আফাজ উদ্দীন। বলেন, 'স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছি কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এই ছিটমহলবাসী স্বাধীনতার দেখা পায়নি। এমনকি এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি পাননি সঠিক আইনগত ঠিকানা না থাকায়। এখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হলেও হয়তো সেই পরিচয়টুকু মিলতে পারে।' তবে কথার শেষে তিনিও শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'এখন আবার ভিটেমাটি হাতছাড়া না হয় সেই দোয়া কইরেন।' আফাজ উদ্দীনের আতঙ্কের কারণ জানতে চাইলে বলেন, 'আমার আদি বাড়ি ছিল পাবনায়। কিন্তু পরে এখানে এসে জমি কিনেছি অন্যদের মতোই সাদা কাগজের চুক্তিপত্রের মাধ্যমে।' আতঙ্ক আছে দুই ছেলে সন্তানের মা বেবী বেগমেরও। তবে এ আতঙ্ক অন্যরকম। পাশে দাঁড়ানো যুবক স্বামী রফিজ উদ্দীনের হাত ধরে বলেন, 'আমাদের এখানকার কারো বিয়েই আইনের চোখে বৈধ নয়। কারণ আমাদের এখানে কোনো কাজী নেই কিংবা বিয়ের আইনকানুন নেই। কেবল হুজুর ডেকে কালেমা পড়ে বিয়ে হয়। তাই স্বামী যদি গলা ধাক্কা দিয়ে আমাদের বের করে দেন কিছুই করার নেই।' পাশ থেকে স্বামী রফিজ বলেন, 'আগে বউকে নিয়ে ভয়ে না থাকলেও এখন ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে। কারণ এখন তো সব কিছুই আইনের আওতায় আসবে। এখানকার কেউ এখন থেকে সহজে আর বউকে নির্যাতন করতে পারবে না। তাইলে বউরা থানা-পুলিশ করে ফেলবে।' বেবী বেগম হাসতে হাসতে বলেন, শুধু বিয়েই নয়, সন্তানদের জন্মেরও বৈধতা নেই। কারণ এখানে জন্মসনদ দেওয়ার কেউ নেই। যাদের প্রয়োজন হয় এলাকার বাইরে গিয়ে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে জন্মসনদ তুলতে হয়। এমনকি এখানকার শিশুদের টিকা দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে আসল ঠিকানা গোপন করে নবজাতক শিশুদের টিকা দিতে হয় তাদের জীবন রক্ষার্থে। কেবল জন্ম পরিচয়ই মিথ্যে নয়, মিথ্যে পরিচয় দিতে হয় চিকিৎসা কিংবা স্কুলে লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও। কারণ ছিটমহলবাসী হিসেবে আসল পরিচয় দিলে কোথাও ঠাঁই হয় না। তা-ও এখানকার কারো উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার নজির নেই। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠলেই কোনো না কোনো পর্যায়ে গিয়ে আটকে যেতে হয়, হয়রানির শিকার হতে হয়। ছিটমহলের মেঠো পথ ধরে স্কুলে যাওয়ার সময় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া নাসিমা আক্তার অন্য সহপাঠীদের আড়ালে মুখ লুকিয়ে বলে, 'সত্য পরিচয় দিলে তো স্কুলেই ভর্তি হতে পারতাম না। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ছিটমহলের পাশে বাংলাদেশের ভেতর ধনিপাড়া বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আমার মতো এখানকার সবাই এমনভাবেই লেখাপড়া করছে।' পরক্ষণেই পেছন থেকে সামনে এসে সাবিনা অনেকটা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে ওঠে, 'এখন আর আমরা মিথ্যা বলে বা লুকিয়ে লেখাপড়া করব না, এখন থেকে তো আমরাও বাংলাদেশি হয়ে যাচ্ছি। ব্যাপারটায় খুবই খুশি লাগছে।' ছিটমহলবাসীর নেতা হাবিবুর বলেন, 'এত দিন এই ছিটমহলের ভেতরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত ব্যবস্থার কোনো উপায় ছিল না। এখন আশা করি সব সমস্যার সমাধান হবে।' তবে ওই নেতার নিজের অস্তিত্ব কতটা ঠিক রাখতে পারবেন তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তাঁর পাশে থাকা লোকজনই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আস্তে করে বলেন, 'হবিবুর রাজনৈতিকভাবে বিএনপির সমর্থক। এত দিন ছিটমহল থাকায় এখানে ভোটাধিকার ছিল না। ফলে কে আওয়ামী লীগ আর কে বিএনপি তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এখন এখানকার সবাই যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাবে, ভোটাধিকার পাবে, তাই এখানে রাজনৈতিক তৎপরতাও শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে এখনই কানাঘুষা শুরু করেছে এই ছিটমহলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার। আর আশপাশের আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের দাপটের কাছে ছিটমহলবাসীর নেতৃত্ব থেকে হাবিবুর ও তাঁর সমমনাদের ছিটকে পড়া এখন হয়তো সময়ের ব্যাপার মাত্র। পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, ছিটমহলগুলোতে নাগরিক কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। এ জন্য ছিটমহল বিনিময়ের পর এসব এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন ও সেবা কার্যক্রম চালাতে হবে। উপজেলা পরিষদ শুরু থেকেই এসব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকবে। তবে এখানে রাজনৈতিকভাবে কেউ কোনো রকম হয়রানি বা অনৈতিক কোনো তৎপরতার শিকার হবে না।
No comments:
Post a Comment