Monday, May 18, 2015

মুক্তিপণের এক কোটি ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার:যুগান্তর

‘তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার বাবার কাছে তোমাকে পৌঁছে দেব।’ এই বলে ৮ বছরের শিশু আবিরকে রাজধানীর বনানী থেকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। তাকে পল্লবীর একটি বাড়িতে পাঁচ দিন আটকে রাখে। অবশেষে মুক্তিপণ হিসেবে ২ কোটি টাকা নিয়ে ৬ মে রাতে তাকে রাজধানীর র‌্যাডিসন হোটেলের সামনে তার বাবার কাছে ফেরত দেয়া হয়। এই অপহরণ চক্রের পাঁচ সদস্যকে রোববার ভোরে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে ওই মুক্তিপণের এক কোট
ি ৮০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১১টি চেক বই উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি টাকা অপহরণকারীরা খরচ করে ফেলেছে। এই অপহরণ চক্রের তিন সদস্য শিশু আবিরের বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘টিএনজেড গ্রুপ অব কোম্পানির’ কর্মচারী। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান রোববার বিকালে র‌্যাব সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন। গ্রেফতারকৃতরা হল- চক্রের মূল হোতা মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, রেজাউল করিম, নজরুল ইসলাম, জহির উদ্দিন মো. বাবর ও শাহ মো. অলিউল্যা। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা জানান, শিশু আবির বাবা শাহাদত হোসেন শামীম টিএনজেড গ্রুপ অব কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার বাসা মহাখালী ডিওএইচএস এলাকায়। অপহরণ চক্রের মূল হোতা মিজানুর রহমান ওরফে মিজান টিএনজেড গ্রুপের বিপুল পরিমাণ টাকা ছিনতাইয়ের জন্য প্রায় এক বছর আগে কোম্পানির দুই কর্মচারীর সঙ্গে পরিকল্পনা করে। তারা হলেন- কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারের গাড়ি চালক রেজাউল ও কোম্পানির ইলেক্ট্রেশিয়ান নজরুল। প্রায় ৫ মাস আগে গাড়িচালক রেজাউল মিজানকে বলেন, কোম্পানি একবারে বেশি টাকা বহন করে না। ফলে ছিনতাই করে বেশি টাকা পাওয়া যাবে না। বরং কোম্পানির মালিক শাহাদত হোসেন শামীমের একমাত্র ছেলে আবিরকে অপহরণ করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করা যাবে। এরপরই তারা আবিরকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করতে থাকে। আবিরকে আটকে রাখার জন্য প্রায় চার মাস আগে অপহরণকারী চক্র পল্লবীতে একটি বাসা ভাড়া নেয়। ওই বাসায় মিজান থাকতেন। মাঝে-মধ্যে চক্রের অন্য সদস্যরা সেখানে গিয়ে আড্ডা ও অপহরণের কৌশল ঠিক করত। আইনশৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে অপহরণের পরিকল্পনা করে তারা। ফলে হ্যান্ডকাফ, লাইট, খেলনা পিস্তলসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যবহৃত সরঞ্জাম সংগ্রহ করে তারা। অপহরণের আগে তারা মাথার চুলও ছোট করে। র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, অপহরণ চক্র নিয়মিত আবিরের ওপর নজর রাখত। আবির উত্তরার একটি মাদ্রাসার ছাত্র। চক্রের প্রধান মিজান ওই মাদ্রাসায় তার এক পরিচিতকে ভর্তিও করায় আবিরের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেয়ার উদ্দেশে। যেভাবে অপহরণ করা হয় : প্রতিদিনের মতো ২ মে প্রাইভেট কারে একজন কেয়ারটেকারসহ মাদ্রাসায় যায় আবির। মাদ্রাসা থেকে রাত সাড়ে ৮টায় ওই প্রাইভেট কারে বাসায় ফিরছিল সে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অপহরণ চক্রের ১২-১৪ জন সদস্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তারা তিনটি দলে ভাগ হয়ে যায়। চক্রের মূল হোতা মিজানুর রহমান ওরফে মিজান একটি গাড়ি নিয়ে মাদ্রাসা থেকে আবিরের বহনকারী গাড়ি অনুসরণ করে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দল একটি এলএক্স নীল রংয়ের প্রাইভেট কার ও একটি নোয়া গাড়ি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের স্টাফ রোড এলাকায় অবস্থান করে। মিজান মোবাইল ফোনে ওই দুই দলকে তথ্য জানায়। আবিরকে বহনকারী প্রাইভেট কারটি বনানী ফ্লাইওভারের নিচে পৌঁছলে মিজানসহ অপর দুই দল তিনটি গাড়ি নিয়ে ওই প্রাইভেট কারের গতিরোধ করে। অপহরণকারীরা গাড়ি থেকে নেমে আবিরের গাড়িচালক ও কেয়ারটেকারকে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে গাড়ি তল্লাশির নামে তাদের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেয়। ওই দু’জনকে গাড়িতে উঠানো হয়। গাড়ির মধ্যে দু’জনের মুখ বেঁধে ফেলে অপহরণকারীরা। এরপরই প্রাইভেট কারটি চালিয়ে নিয়ে যায় অপহরণ চক্রের এক সদস্য। কারটি কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ফেলে রেখে আবিরকে অন্য একটি গাড়িতে করে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। আবিরের চালক ও কেয়ারটেকারকে এয়ারপোর্ট এলাকায় ফেলে দেয়া হয়। আবিরকে ওই রাতে পল্লবীর ভাড়া বাসায় নিয়ে আটকে রাখে। এরপর রাতেই তার বাবা শাহাদত হোসেন শামীমের কাছে মোবাইল ফোনে ১০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা জানায়, ছেলেকে জীবিত ফেরত পেতে হলে র‌্যাব-পুলিশকে জানানো যাবে না। টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় তারা। যেভাবে ছাড়া পায় আবির : শিল্পপতি শাহাদত দাবিকৃত ১০ কোটি টাকা দিতে পারবে না বলে অপহারণকারীদের জানান। একপর্যায়ে দুই কোটি টাকায় রফা হয়। অপহরণ চক্রের তিন সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কয়েক দফায় এক কোটি ৭৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেন তিনি। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকছে এটি নিশ্চিত হওয়ার পর অবশিষ্ট নগদ ২৭ লাখ টাকা নিয়ে ৬ মে সন্ধ্যায় র‌্যাডিসন হোটেলের সামনে শাহাদতকে আসতে বলে অপহরণকারীরা। সিএনজি অটোরিকশায় তিনি ২৭ লাখ টাকা নিয়ে সেখানে যান। ওই টাকা হাতে পাওয়ার পর আবিরকে তারা শাহাদতের কাছে ফেরত দেয়। র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ খান বলেন, অপহরণের পরেই র‌্যাব খবর পায়। কিন্তু ছেলেকে জীবিত ফেরত পাওয়ার জন্য শাহাদত হোসেন নিজেই অপহরণকারীদের সঙ্গে সমঝোতা করে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দেন। র‌্যাব সদস্যরা অপহরণ চক্রকে ধরার জন্য জাল পাতে। অবশেষে রোববার ভোরে অপহরণ চক্রের মূল হোতা মিজানুর রহমান, রেজাউল করিম, নজরুল ইসলাম, জহির উদ্দিন মো. বাবর ও শাহ মো. অলি উল্যাকে উত্তরা এলাকা থেকে আটক করে। তিনি আরও বলেন, মুক্তিপণ হিসেবে অপহরণকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত টাকা যাতে তারা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়। চক্রের সদস্যরা গ্রেফতারের পর ওই টাকা উত্তোলন এবং তাদের কাছে নগদ আরও কিছু টাকা পাওয়া যায়, যা মোট এক কোটি ৮০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এছাড়া তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের ১১টি চেক বই উদ্ধার করা হয়। অপহরণ চক্রের অপর সদস্য মন্টু, কাওসার, শুভম সজিব, চন্দন ও আবদুল্লাহসহ অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।  

No comments:

Post a Comment