মোবাইল কোর্ট আইন সংশোধন করে ম্যাজিস্ট্রেটকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে। অপরাধী দোষ স্বীকার না করলেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারে অভিযুক্তকে দণ্ড দিতে পারবেন। অপরাধী পালিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার হুকুম দেয়া যাবে। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে আমলে নিতে পারবেন সংঘটিত অপরাধের ছবি, অডিও-ভিডিও ক্লিপ। পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেটের চাহিদামাফিক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনে ব
াধ্যবাধকতা আরোপ করে আইন সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। খসড়াটি অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্র আরও জানায়, এই প্রথমবারের মতো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থার সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ‘দ্য জুডিসিয়াল অফিসারস প্রটেকশন অ্যাক্ট ১৮৫০’-এর আওতা অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান মোবাইল কোর্ট আইন আরও শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করতে কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে। অপরাধ করেও অনেকে স্বীকার না করায় দণ্ড দেয়া যায় না। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে চাক্ষুষ সাক্ষী ও পারিপার্শি^ক অবস্থা বিবেচনা করেও দণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। পাশাপাশি আদালত তথ্য-প্রমাণ হিসেবে ছবি, অডিও এবং ভিডিও ক্লিপ আমলে নিতে পারবেন। এছাড়া আদালতের চাহিদামাফিক প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন নিশ্চিত করার বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের। তাদের অভিযোগ প্রায়শই চাহিদামত আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য পাওয়া যায় না। শুধু এ কারণে কিছু ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান বাতিল করতে হয়েছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাঠ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ডিসি-এসপি এবং ইউএনও-ওসি দ্বন্দ্বের কারণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য প্রায় সময়ই আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের পাওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে প্রতি বছরই জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে আলোচনা হয়। আইন সংশোধন করতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তারা আরও জানান, সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরও শুধুু অপরাধ স্বীকার না করায় তাকে শাস্তি বা দণ্ড দেয়া যাচ্ছে না। ফলে আইনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও চলতি বছরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ৯৩ দিনের লাগাতার হরতাল-অবরোধের সময় বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। এ সময় বাস ও পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন দিয়ে প্রায় দেড়শ’ মানুষকে হত্যা করা হয়। অপরাধসংক্রান্ত অডিও-ভিডিও ফুটেজ সরকারের কাছে থাকলেও তাৎক্ষকিভাবে এসব বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। আগামীতে এ ধরনের অপরাধের তাৎক্ষণিক বিচার করার জন্য মোবাইল কোর্ট আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের মতের ভিত্তিতে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ (সংশোধনী-২০১৫) এর খসড়া তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর খসড়াটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো সার-সংক্ষেপে বলা হয়, আইনশৃংখলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে কার্যকর ও অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনের জন্য মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ জন্য এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে কিছু অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে গ্রহণভপূর্বক দণ্ড আরোপের সীমিত ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। আইনটি প্রয়োগের সময় বাস্তব ক্ষেত্রে কিছু কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ২০১৩ সালের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে আইনমন্ত্রীর কাছে আইনটির কিছু ধারার সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২১ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। যা সংশোধন হচ্ছে : মোবাইল কোর্টের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন বাধ্যতামূলক করে বিদ্যমান আইনের ১২(১) ধারা সংশোধন করা হচ্ছে। সংশোধনীর প্রস্তাবে বলা হয়- ‘এই আইনের অধীন মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট- পুলিশ বাহিনী, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা চাহিলে পুলিশ বাহিনী, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কাজে আবশ্যিকভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য নিয়োগ নিশ্চিত করিবে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান অনুরূপ চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করিবে।’ আইনের ৬(১) সংশোধন করে বলা হয়- ‘ধারা ৫ এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ধারা ১১-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃংখলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করিবার সময় তফসিলে বর্ণিত আইনের অধীন কোনো অপরাধ, যাহা কেবল জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য, তাহার সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হইয়া থাকিলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, অথবা চাক্ষুষ ঘটনা, উপস্থিত সাক্ষীদের বক্তব্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারে, দোষী সাব্যস্ত করিয়া, এই আইনের নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করিতে পারিবেন।’ প্রসঙ্গত, বিদ্যমান আইনে ‘অথবা চাক্ষুষ ঘটনা, উপস্থিত সাক্ষীদের বক্তব্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারের’ বিষয়টি উল্লেখ নেই। সংশোধনীর মাধ্যমে বিদ্যমান আইনে এ অংশটুকু সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অপরাধী পালিয়ে গেলে তার বিষয়ে আইনের ৬ ধারায় নতুন উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংযোজনীতে বলা হয়েছে- ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করিবার সময় যদি এইরূপ কোনো অপরাধ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হয় বা প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায় কিন্তু অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, তাহা হইলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ এজাহার হিসেবে গণ্য করিবার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ প্রদান করিতে পরিবেন।’ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে নতুনভাবে সংযোজন করা ৭(৫) ধারায় বলা হয়েছে- ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক অভিযোগ অস্বীকার করিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য প্রদান করিলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট চাক্ষুষ ঘটনা, উপস্থিত সাক্ষীদের বক্তব্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারে তাহার বিবেচনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া যথোপযুক্ত দণ্ড আরোপ করিয়া লিখিত আদেশ প্রদান করিবেন।’ কোর্ট পরিচালনাকালে উপস্থিত যে কোনো সংস্থার বিশেষজ্ঞের মতামত নেয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে উপধারা-৬-এ। এতে বলা হয়েছে ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পরিচালনাকালে উপস্থিত বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে পারবেন।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো ছবি, অডিও-ভিডিও ক্লিপকে সাক্ষ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রেখে বিদ্যমান আইনের ৭ ধায়ায় নতুন আরও একটি উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। উপধারায় বলা হয়েছে- ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও আপিল আদালত কার্যক্রমে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার করা যাইবে। মোবাইল কোর্টে কোনো ছবি, অডিও অথবা ভিডিও ক্লিপ সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, প্রসিকিউটিং এজেন্সি, অভিযুক্ত ব্যক্তি, কোনো সাক্ষী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তির স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক স্বাক্ষর এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আঙ্গুলের ছাপসহ বায়োমেট্রিক্স ব্যবহার করা যাইবে।’
No comments:
Post a Comment