মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগমুহূর্তে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা হাতে নিয়ে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা ও গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে সেই আলবদর বাহিনীর অন্যতম নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির সাজা বহাল রাখলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী ম
ুজাহিদকে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ‘বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, অতীতেও ছিল না’—এই দম্ভোক্তি করা মুজাহিদ নিজেই যুদ্ধাপরাধী প্রমাণিত হন সেদিন। খালাস চেয়ে ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে নিশ্চিত হলো যে মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধী এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে তাঁর সর্বোচ্চ সাজাই প্রাপ্য। এর আগে আপিল বিভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলার রায় দিয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইতিমধ্যে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন। চূড়ান্ত রায়েও মুজাহিদের ফাঁসি বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, কোনো ব্যক্তি নিজ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ রায়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে। তবে আসামিপক্ষ দাবি করেছে, তারা ন্যায়বিচার পায়নি। মুজাহিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে তাঁরা রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবেন। এই রায়ের প্রতিবাদে আজ বুধবার সকাল ছয়টা থেকে কাল বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা হরতাল ডেকেছে মুজাহিদের দল জামায়াতে ইসলামী। নিয়ম অনুসারে, পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন মুজাহিদ। তাতেও যদি দণ্ড বহাল থাকে, তাহলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন তিনি। সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলে সাজা কবে ও কীভাবে কার্যকর হবে, তা ঠিক করবে সরকার। এক মিনিটের রায়: গতকাল সকাল নয়টায় প্রধান বিচারপতির এজলাসে দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। নিজ নিজ আসনে বসেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ৯টা ৭ মিনিটে পাঁচ লাইনের সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনান প্রধান বিচারপতি। বলেন, আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হলো। আবেদনকারী আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদকে ১ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হলো। ৩, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগে দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখা হলো। ৩, ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগে তাঁর সাজা বহাল রাখা হলো। ৭ নম্বর অভিযোগে তাঁর সাজা কমিয়ে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। এক মিনিটের মধ্যে রায় ঘোষণা শেষ করে এজলাস ত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ। রায় ঘোষণার সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন মুজাহিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, এস এম শাহজাহান ও শিশির মনির এবং মুজাহিদের দুই ছেলে আলী আহমদ তাহকিক ও আলী আহমদ মাবরুর। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও মুরাদ রেজা, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক প্রমুখ। যা ছিল, যা হলো: ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। প্রথম অভিযোগ শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যাকাণ্ডে মুজাহিদের দায় প্রমাণিত হলেও এতে আলাদা করে সাজা দেননি ট্রাইব্যুনাল। কারণ, ওই অভিযোগটি ষষ্ঠ অভিযোগের সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়। ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাতে মুজাহিদকে ফাঁসি দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগের রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে ফাঁসি বহাল রেখে সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যাকাণ্ড থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। তৃতীয় অভিযোগ ছিল, ১৯৭১ সালের জুনে ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামের রণজিৎ নাথকে আটকে রেখে নির্যাতন। এ অভিযোগে মুজাহিদকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৩০ আগস্ট নাখালপাড়ার পুরাতন এমপি হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বদি, রুমী, জুয়েল, আজাদ, সুরকার আলতাফ মাহমুদ প্রমুখদের হত্যায় প্ররোচনা দেন মুজাহিদ। এ অভিযোগে তাঁকে আজীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এ দুই অভিযোগেই ট্রাইব্যুনালের সাজা বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদ ও তাঁর সহযোগীরা ফরিদপুরের সদর থানার বকচর গ্রামের কয়েকজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে আজীবন কারাদণ্ড দেন। দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মুজাহিদকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল। এ দুটি অভিযোগে আপিল করেনি রাষ্ট্রপক্ষ। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও মুজাহিদ: একাত্তরের খুনে বাহিনী আলবদরের সঙ্গে মুজাহিদের সংযোগ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নের পুরো চিত্র তুলে ধরা হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এতে বলা হয়, একাত্তরের অক্টোবর পর্যন্ত মুজাহিদ ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সেক্রেটারি, পরে সভাপতি হন। ওই সময় ছাত্র সংঘের সদস্যরা আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। ছাত্র সংঘের ঊর্ধ্বতন নেতা হিসেবে আলবদর ও ছাত্র সংঘের ওপর মুজাহিদের কর্তৃত্ব ছিল। ওই কর্তৃত্ববলে তিনি আলবদর বাহিনীকে দিকনির্দেশনা দিতেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আলবদরের আনুষ্ঠানিক কোনো নথিতে মুজাহিদের নাম থাকা জরুরি নয়। সব ধরনের নথি ও সাক্ষ্য মূল্যায়ন করে বোঝা যায়, আলবদর গঠন থেকে শুরু করে হত্যা-নিধনযজ্ঞের শেষ পর্যন্ত এ বাহিনীর ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। পাকিস্তানি গবেষক সেলিম মনসুর খালেদের আলবদর বই অনুসারে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্র সংঘের প্রধান (নাজেম) মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর উদ্দেশে তাঁর শেষ ভাষণ (আখেরি খিতাব) দেন। তাঁর সঙ্গে আলবদরের অনানুষ্ঠানিক ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে আরও বলা হয়, একাত্তরে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজ (তৎকালীন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) ছিল আলবদরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। মুজাহিদের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতায় স্বাধীনতামনা বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগকে চোখ বেঁধে প্রথমে এখানেই নিয়ে আসত আলবদর বাহিনী। নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর এখান থেকেই তাঁদের রায়েরবাজারে ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ীসহ অন্যান্য বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হতো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন এখানেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে মুজাহিদ আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ ভাষণ দিচ্ছিলেন। অপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ রায়ের: সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার পর দুই পক্ষ এখন অপেক্ষা করছে পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য। অ্যাটর্নি জেনারেল আশা করছেন, খুব শিগগির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হবে। গতকাল রায়ের পর নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বের হওয়ার পর থেকে রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে। তখন যদি আসামিপক্ষ পুনর্বিবেচনার আবেদন করে, তবে রায় কার্যকর স্থগিত হয়ে যাবে। আর খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আমরা পুনর্বিবেচনার আবেদন করব।’ তাঁর দাবি, মুজাহিদকে ফাঁসি দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল না। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের এক মামলায় মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই সময় থেকে তিনি কারাবন্দী। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায়ও তাঁর বিচার চলছে।
No comments:
Post a Comment