Wednesday, June 17, 2015

দম্ভোক্তি টিকল না মুজাহিদের:প্রথম অালো

২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর, দুপুর সোয়া ১২টা। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নির্বাচনী আইন সংস্কার বিষয়ে বৈঠক করে বের হচ্ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। সেখানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেন, বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী নেই, ছিল না। যুদ্ধাপরাধীও নেই। এর প্রায় আট বছর পর মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দ
ায়ে সর্বোচ্চ আদালত তাঁর ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখলেন। আদালতের রায়ের কারণে মুজাহিদের সেই দম্ভোক্তি শেষ হয়ে গেল। প্রমাণিত হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা আর অপরাধ। স্বাধীনতাবিরোধীদের ভোটাধিকার না দেওয়ার দাবিসংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী নেই, ছিলও না। কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। এটা বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত।’ সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তা মূল্যায়ন করতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিলেন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৈনিক সংগ্রাম-এর বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান ছিলেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে এই বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন শুরু করেন তিনি। এই বাহিনীর গোটা পাকিস্তান শাখার প্রধান বা কমান্ডার ছিলেন জামায়াতের বর্তমান আমির ও মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামী। আলবদর ও আলশামস বাহিনী ছিল জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ আছে এই দুটি বাহিনীর বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে নিজামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে সমাবেশে বলেছিলেন, ‘মুসলমানরা যখন রাজনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা রাজনৈতিক পন্থায় করতে ব্যর্থ হলো, তখন আল্লাহ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তাঁর প্রিয় মাতৃভূমির হেফাজত করেছেন।’ জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট সংখ্যায় তাঁর এ বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এদিকে দলীয় ও বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েক বছর নিষ্ক্রিয় ছিলেন মুজাহিদ। এরপর এক দশকেই তাঁর উত্থান ঘটে জামায়াতে ইসলামীতে। বিশেষ করে, ২০০০ সালে দলের সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হওয়ার পর অল্প সময়ের ব্যবধানেই মুজাহিদ দলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। দলের নীতিনির্ধারণে তাঁর ভূমিকা থাকত বেশি। এমনকি তা কখনো কখনো আমিরের ক্ষমতাকেও খর্ব করত। ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদের সময় মুজাহিদ জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রথম ফরিদপুরে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন। তারপর একে একে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চারবারই পরাজিত হন। জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নিতে আলী আহসান মুজাহিদের ভূমিকা ছিল বেশি। এ জন্যই নির্বাচনে চারবার হেরেও ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী করা হয় তাঁকে। এর আগে ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম নেতা ছিলেন মুজাহিদ। এভাবেই নিজ দলে এবং জোটে প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন তিনি। মন্ত্রী হওয়ার পর মুজাহিদের যে পরিচিতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, তাতে রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়, মুজাহিদ বরাবরই দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ছাত্র আন্দোলনে, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, ২০০০ সালে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলনে এবং ২০০৭ সালে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে এই পরিচিতিতে একাত্তরের ভূমিকার কথা উল্লেখ নেই। দলীয় ও পারিবারিক সূত্র জানায়, মুজাহিদের বাবা আবদুল আলী ফরিদপুর থেকে জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৬২-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও (এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। পিতার পথ ধরে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে আসামির পরিচিতিতে বলা হয়েছে, এই মামলার আসামি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজে ছাত্রাবস্থায় ইসলামী ছাত্রসংঘে (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন) যোগ দেন। ১৯৬৮-৭০ সালে তিনি ফরিদপুর জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওই বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হন। একাত্তরের অক্টোবরে তিনি ছাত্রসংঘের সভাপতি হন।

No comments:

Post a Comment