ডুবে যাওয়া দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব থাকলে বাংলাদেশের সাগর এলাকা এখনকার চেয়ে আরো কমে যাওয়ার জোর সম্ভাবনা ছিল। কারণ ১৯৪৭ সালের রেডক্লিফের সীমানা রেখা অনুযায়ী দক্ষিণ তালপট্টি এলাকা ভারতের মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণী মামলায় ভারত দক্ষিণ তালপট্টিকে 'দ্বীপ' বা ভূখণ্ড দাবি করে সীমারেখা টানার 'বেস পয়েন্ট' হিসেবে ধরার যুক্তি তুলে ধরে। আদালতের কাছে তা গৃহীত হলে বেস পয়েন্টের দাব
িও গুরুত্ব পেত। ফলে বর্তমান সমুদ্রসীমা রেখা বাংলাদেশের আরো ভেতরের দিকে আসত। অর্থাৎ বর্তমানের চেয়ে কম সাগর অঞ্চল পেত বাংলাদেশ। গত সোমবার নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বাংলাদেশ বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের তিন ভাগের দুই ভাগও দিতে রাজি ছিল না ভারত। সার্বিক বিচারে আদালতের রায়ে বাংলাদেশ বিশাল জয় পেয়েছে। আদালতের রায়ের ফলে রায়মঙ্গল নদীর পুরোটাই বাংলাদেশ পেয়েছে। অন্যদিকে হাড়িয়াভাঙ্গা নদী পড়েছে ভারতে। আদালতের রায়ের আগে ভারত পুরো রায়মঙ্গল নদীটিই নিজের দাবি করে আসছিল। তবে সমুদ্র বিশেষজ্ঞ নূর মোহাম্মদ বলেছেন, নদী ও দ্বীপ ভাগাভাগির এখতিয়ার ওই আদালতের নেই। আদালত রেডক্লিফের সীমান্ত রেখা বরাবর সাগরের সীমানা টানায় ওই নদীগুলো দুই দেশের ভাগে পড়েছে। এদিকে ডুবে যাওয়া দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ প্রসঙ্গে মামলা প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ওই দ্বীপটি ডুবন্ত অবস্থায় ভাঙনের শিকার হয়ে নিচে ঘোরাঘুরি করছে বা মিশে গেছে। এমন হতে পারে যে দ্বীপটি আবার কোনো এক সময় জেগে উঠবে। তবে সেটি আগের স্থানে নাও হতে পারে। জানা গেছে, তালপট্টি দ্বীপ যেখানে ছিল, এর ঠিক পাশ দিয়ে সীমানা রেখা টানা হয়েছে। ওখানে দুটি চ্যানেল আছে। একটি অগভীর, অন্যটি গভীর। ভারতের দাবি ছিল, গভীর চ্যানেলটিকে আধাআধি ভাগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ীও এর যৌক্তিকতা ছিল। তবে আদালত গভীর চ্যানেলটির পুরোটিই বাংলাদেশকে দিয়েছে, আর অগভীর চ্যানেলটি দিয়েছে ভারতকে। ওই ভাগাভাগির সময় তালপট্টি ভারতের দিকে গেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, নৌচলাচলের অধিকার বিবেচনায় গভীর চ্যানেল থেকেও ভারতের কিছু পাওয়ার কথা ছিল। নৌচলাচলের অধিকার এখন বিশ্বজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমন ধারণার পরও গভীর চ্যানেলের পুরোটাই বাংলাদেশের ভাগে পড়েছে। সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা ভাগ হয়েছে ১৯৪৭ সালের রেখা অনুযায়ী। এখানে কারো কিছু করার নেই। এখানে ভারতও কিছু করতে পারেনি, বাংলাদেশও পারেনি। আদালত ১৯৪৭ সালের ভাগটি নতুন করে বলে দিয়েছে। ভারতের বিচারক শ্রিনিবাসা রাও অন্য চার বিচারকের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন, এত এলাকা বাংলাদেশের পাওয়ার কথা নয়। জানা গেছে, গত মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরে আনুষ্ঠানিক বৈঠকেও সমুদ্রসীমার সম্ভাব্য রায়-পরবর্তী বিষয় উঠেছিল। ভারতের দিক থেকে প্রত্যাশা ছিল রায় নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস না দেখানোর। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে বলা হয়েছিল, দীর্ঘদিনের এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান দুই দেশের জনগণেরই বিজয়। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ২০০৮ সালের পর ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নিয়ে চারটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছে। ভারতের দিক থেকে বরাবর বলা হয়েছে, তারা পাঁচটি সীমানা এরই মধ্যে সমাধান করেছে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে। ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে 'ইকুয়িডিস্ট্যান্স প্রভিশনালি' করে সীমারেখা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তারা সমদূরত্ব পদ্ধতির বাইরে যেতে পারবে না। বাংলাদেশের ন্যায্যতার দাবি ভারত বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১০ সালে বাংলাদেশ মানচিত্র সংশোধন করে ডুবে যাওয়া দক্ষিণ তালপট্টি নিজের বলে দেখালেও আদালত তা গ্রহণ করেননি। অতীতের নথিপত্রগুলোতেও দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ এলাকা ভারতের সঙ্গে বেশি সংগতিপূর্ণ এমন প্রমাণ মিলেছে। ১৯৭৬ সালের দিকে ভারত প্রথম দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে নিজেদের বলে ব্রিটিশ অ্যাডমিরালটিতে নোটিশ পাঠিয়েছিল। ভারতের সঙ্গে মামলায় বাংলাদেশের পক্ষের ডেপুটি এজেন্ট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (সমুদ্রবিষয়ক ইউনিট) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বলেন, '১৯৪৭ সালের রেডক্লিফের রেখা যেখানে এসে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই সমুদ্রসীমা শুরু হয়েছে। আর তা সোজা শুরু হয়েছে। সোজা শুরু হওয়ার কারণে ওই জায়গাটুকু, যার পরিমাণ ১ দশমিক ১৩ বর্গকিলোমিটার, সেটি ভারতের দিকে পড়েছে। সেখানে পানির ওপর কিছুই নেই। মূলত আমাদের দেখতে হবে, আদালত কী দেখেছে। আদালত সেখানে পানি দেখেছে। তারা পানি ভাগ করেছে। দ্বীপ বলে সেখানে কিছু নেই।' তিনি বলেন, 'এমনকি আদালত যখন সরেজমিন এখানে এসেছিল তখনো আমরা এই তালপট্টিকে দ্বীপ হিসেবে দেখাতে পারিনি। ভারত প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তারা ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে চেষ্টা করেছিল ওই স্থানটিকে দ্বীপ হিসেবে দেখাতে। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়েছে।' তিনি আরো বলেন, "ভারত তালপট্টি এলাকাকে দ্বীপ প্রমাণ করে 'বেস পয়েন্ট' হিসেবে দেখাতে চেয়েছিল। দ্বীপটি যদি বেস পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেত, তাহলে সীমানা রেখা আমাদের বর্তমান সীমানার আরো ভেতরে চলে আসত। এর ফলে সীমানা রেখা সোজা যেত না। তাদের দাবিও সে রকম ছিল। আদালত যেহেতু তাদের দাবি মানেনি, সেহেতু তালপট্টি দ্বীপ বলে সেখানে কিছু নেই। থাকলে তো ভারতের দাবি অনুযায়ী সমদূরত্ব পদ্ধতিতে রেখা হতো। সে ক্ষেত্রে আমরা সাগর আরো বেশি হারাতাম।" মো. খুরশেদ আলম বলেন, 'প্রথমত, ১৯৪৭ সালের রেডক্লিফের সীমানা সবার জন্য মানার বাধ্যবাধকতা আছে। এখানে আমাদের তেমন কিছুই করার নেই। দ্বিতীয়ত, যেহেতু তালপট্টি দ্বীপটি এখন নেই সেখানে পানি ভাগ হয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, ৫০ বছর পর দ্বীপটি আবার জেগে উঠবে কি না? জেগে উঠলেও আমাদের তেমন কিছু করার থাকবে না। একইভাবে সীমারেখার পূর্ব পাশে যদি কোনো দ্বীপ জেগে ওঠে, যে জায়গা ভারতের দাবির মধ্যে ছিল ও রায়ে বাংলাদেশের মধ্যে পড়েছে, সেখানেও তারা কিছু করতে পারবে না।' মো. খুরশেদ আলম বলেন, 'আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয় তখনো ভারতকে বলেছিলাম, আপনারা সাড়ে ১২ নেন, আমাদের সাড়ে ১২ দেন। ভারত বলেছে, না, পুরোটাই ছেড়ে দিতে হবে। সেখানে ৭৫ শতাংশ আমাদের দখলে আসাকে আমি মনে করি বাংলাদেশের জন্য বিরাট অর্জন।' তালপট্টি কেবলই স্মৃতি : সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞ এবং সমুদ্র অঞ্চল ও সীমানা রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক নূর মোহাম্মদ গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, তালপট্টি দ্বীপের দাবি নিয়ে বাংলাদেশ আদালতে যায়নি। দ্বীপ নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির এখতিয়ার ওই আদালতের নেই। ওই আদালত কেবল সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করে। বাংলাদেশ যা রায় পেয়েছে তা সন্তোষজনক। তিনি বলেন, 'তালপট্টি নিয়ে যাঁরা কথা বলেন, তাদের কাছে আমি জানতে চাই এর ভৌগোলিক অবস্থান তারা জানেন কি না। তাঁরা এর উত্তর দিতে পারেন না। তালপট্টি আদৌ দ্বীপ ছিল কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ দ্বীপ হতে হলে জোয়ার ও ভাটা উভয় সময়েই সেটিকে ভেসে থাকতে হয়। শুকনো ভূখণ্ড থাকতে হয়। ৩০ বছর ধরে তালপট্টির কথা বলা হলেও কোনো মানচিত্রে এটি ছিল না। ১৯৭০ সালের আগেও ছিল না। এখনো এর অস্তিত্ব নেই। এটি এখন কেবলই স্মৃতি।'
No comments:
Post a Comment