Tuesday, July 22, 2014

পাবনা-সিরাজগঞ্জের কাপড়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে:নয়াদিগন্ত

ঈদ ও পূজা সামনে রেখে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁতপ্রধান এলাকাগুলো এখন কর্মমুখর হয়ে উঠেছে। এখানে তৈরি হচ্ছে আধুনিক রুচিশীল কাপড়। জামদানি, সূতি জামদানি, সুতি কাতান, চোষা, বেনারশি, শেড শাড়ি ও লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে তাঁতপল্লীগুলোতে। শাড়ির ওপরে বর্ণিল সুতা, বাক ও চুমকির কাজও করা হচ্ছে। এ ছাড়া, কাপড়ের ওপর প্রিন্ট এবং রঙ তুলির আঁচড়ে হাতে করা হচ্ছে নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নানা নকশা। নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নানা নক
শার তৈরি কাপড়ের চাহিদা ও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে। পাবনার ঈশ্বরদী ও সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর ও শাহজাদপুরের তৈরি বেনারশি শাড়ি ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের চাহিদানুযায়ী কাপড় সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁত কারখানার মালিকেরা। কাপড়ের উৎপাদন বাড়াতে দিন-রাত কাজ করে চলেছেন তাঁত শ্রমিকেরা। কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কোলাহলে সরব হয়ে উঠেছে বেলকুচি, চৌহালী উপজেলার পশ্চিম পাড় এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর ও ঈশ্বরদী উপজেলার তাঁত পল্লী। দিন-রাত তাঁতের খট খট শব্দ জানান দিচ্ছে, এ শিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরতে শুরু করেছে। বাজারে কাপড়ের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দামও অনেক বেড়েছে। গত বছরের এ সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ দামে কাপড় কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে রঙ-সুতাসহ তাঁত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিকেই  দায়ী করছে তাঁত ব্যবসায়ের সাথে জড়িতরা। সরেজমিন তাঁতপ্রধান এলাকা পুকুরপাড়, নগরডালা, ডায়া, গোপিনাথপুর, খুকনী, শিবপুর গাছপাড়া, তালতলা, এনায়েতপুর, বেতিল, খামারগ্রাম, উল্লাপাড়া, হাতিগাড়া, বনগ্রাম, সান্যালপাড়া, ছেঁচানিয়া, দোগাছি, কুলোনিয়া ও ঈশ্বরদী, খঞ্জনদিয়ার, রামবাড়ি, পুকুরপাড়, মনিরামপুর, প্রাণনাথপুর, শক্তিপুর, ঘাটপাড়া, আন্ধারকোঠাপাড়া, রূপপুর, উড়িয়ারচর, নগরডালা, ডায়া, হামলাকোলা, জুগ্নিদহ, গাছপাড়া, কামালপুর, রূপসী ও ছোট চাঁনতারা গ্রাম ঘুরে তাঁতি এবং তাঁত শ্রমিকদের ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। বসে নেই নারীরাও। পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে নলীভরা, সুতাপারি করা, মাড়দেয়া ও রঙ-তুলিতে নকশা আঁকাসহ কাপড় বুননের কাজেও সহযোগিতা করছেন ওই এলাকার নারী শ্রমিকেরা।  পাবনা তাঁতি সমবায় সমিতির সভাপতি শাহজাহান আলী আশরাফী জানান, গত এক দশক ধরে সুতা, রঙ ও তাঁত উপকরণের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধি এবং ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসনে তাঁতশিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ওই সময় অনেক তাঁতিই পুঁজি সঙ্কটে পড়ে কারখানা বন্ধ করে দেন। ফলে লাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। সঙ্কটাপন্ন দেশীয় এই তাঁত শিল্পে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক মানের এবং সময়োপযোগী ডিজাইন নিয়ে আসায় এ শিল্প প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে। তাঁতিরা এ শিল্পকে আর অলাভজনক পেশা হিসেবে দেখছেন না। মান্ধাতা আমলের বুনোনশৈলী ও জ্যাকেট পাইড়ের শাড়ি বাদ দিয়ে ডিজাইনারদের পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁতের কাপড় বিক্রিতে এখন আর মন্দাভাব নেই। এ পেশার সাথে জড়িত সবাই এখন লাভের মুখ দেখছেন। সময়োপযোগী করে বুনোনশৈলী আর রঙের মাধুর্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে এ অঞ্চলের তাঁতের কাপড়।  চলতি বছরের শুরু থেকেই তাঁতিদের সফলতা আসতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলের তাঁত পল্লীগুলোতে উন্নত মানের জামদানি, সুতি কাতান, চোষা, সুতি জামদানি, বেনারশি ও শেট শাড়ির পাশাপাশি মোটা শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস ও থান কাপড় তৈরি হচ্ছে। এসব শাড়ি ও লুঙ্গি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি হচ্ছে।  শাহজাদপুরের পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ী আল হেলাল জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা শাহজাদপুর ও আতাইকুলা হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৫ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সেন জানান, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের তৈরি কাপড় ভারতের কলকাতা শুভরাজ, গঙ্গা রামপুর ও পাটনাসহ বড় বড় শহরে বিক্রয় হচ্ছে। সে দেশের চেয়ে এ দেশের কাপড়ের দাম তুলনামূলক কম, টেকসই এবং উন্নত মানের হওয়ায় তারা এখান থেকে কাপড় কিনছেন। তিনি জানান, ভারতের রফতানিকারকদের কাছে বাংলাদেশের লুঙ্গির চাহিদা সব চেয়ে বেশি। তারা বাংলাদেশী লুঙ্গি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি করছেন। বিবিআনা, রঙ, কে-ক্রাফট ও নগরদোলাসহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় বুটিক প্রতিষ্ঠানের কাপড় এখন সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলে তৈরি হয়। বুটিক হাউজগুলোর নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রত করে কাপড় তৈরি করা হচ্ছে। বুটিক হাউজের ওড়না থান কাপড় ও এন্ডি থান কাপড়ের ফ্রেবিকস তৈরি করা হচ্ছে তাঁত পল্লীগুলোতে। এ দিয়ে নানা ধরনের পোশাক তৈরি করছে বুটিক হাউজগুলো। তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে তাঁতিরা উন্নতমানের জামদানি নকশা, শেড ও থান কাপড় তৈরি করছেন। এ দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ আর ফতুয়া তৈরি হচ্ছে। জামদানি থ্রি-পিস ২০০০ হাজার থেকে ৩০০০ হাজার টাকা এবং চেক থ্রি-পিস ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।  ঈদকে সামনে রেখে স্বর্ণলতা নামে নতুন একটি শাড়ি বাজারে এনেছেন শাহজাদপুরের তাঁতিরা। এ শাড়ির প্রকৃত নাম সাউথ কাতান। হাফ সিল্কের ওপর ঝুটের মনোমুগ্ধকর নকশা করা। ইতোমধ্যেই এ শাড়ি ক্রেতাদের মন কেড়েছে। বাজারে এর দাম ২০০০ থেকে ৩০০০ হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এ শাড়ির চাহিদা এখন আকাশছোঁয়া।  তাঁত মালিক সমিতির নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন ও আব্দুল আলীম মীর বলেন, সুতার দাম কিছুটা কমলেও ৮৫ টাকা পাউন্ডের সুতা বর্তমানে ১৫৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তার ওপর শ্রমিকদের মজুরিসহ তাঁত উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে কাপড়ের উৎপাদন খচর বেড়ে গেছে। ফলে তাঁতিদের বেশি দামে কাপড় বিক্রি করতে হচ্ছে। বাজারে কাপড়ের চাহিদা থাকায় ঈদ ও পূজা পর্যন্ত তার কারখানায় যত কাপড় তৈরি হবে তা আগাম বিক্রি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী তাঁতি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ন ইসলাম খান নয়া দিগন্তকে বলেন, তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে উপকরণের মূল্য প্রান্তিক তাঁতিসহ শিল্পের সাথে জড়িতদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখে অধিক বস্ত্র উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করতে হবে। মিল রেট চালু করতে হবে। এ ছাড়া দেশে কাপড়ের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানির করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ তাঁতশিল্পীদের উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের বস্ত্র উৎপাদনে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

No comments:

Post a Comment