Tuesday, August 19, 2014

সাত মাসে আত্মহত্যা ১২, চেষ্টা ৯৮ জনের:প্রথম অালো

সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোকসানা খাতুন (১৩)। রংপুরের বদরগঞ্জের রাধানগর পাঠানপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের এই ছাত্রীর বিয়েতে মত ছিল না। গত ১ জুন জোর করে স্বামীর ঘরে পাঠানো হয়। মেয়েটি ওই দিন বিকেলেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে।  মুঠোফোনে বেশি কথা বলার জন্য উপজেলার মধুপুর রাজারামপুরের দশম শ্রেণির ছাত্রী শিউলি রানীকে (১৬) বড় ভাই বকাঝকা করেন। ৫ জুন ঘরের বাঁশের আড়ার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে রাত নয়টার দিকে শিউলি আ
ত্মহত্যা করে। এমন একটি-দুটি ঘটনা নয়, বদরগঞ্জ থানা ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তথ্য বলছে, উপজেলায় এ বছরের প্রথম সাত মাসেই (জুলাই পর্যন্ত) ১২ জন আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে আটজনই শিক্ষার্থী। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে ৯৮ জন। ২০১৩ সালে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল পাঁচ এবং ২০১২ সালে তিনজন। মোট আটজনের মধ্যে পাঁচজনই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এই দুই বছরে আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর সংখ্যা ছিল মোট ৫৬। তার মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৬। অধিকাংশই কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বদরগঞ্জ উপজেলায় আত্মহত্যা ও এর চেষ্টার প্রবণতা বাড়ছে। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা একে ‘উদ্বেগজনক’ মন্তব্য করে এর কারণ অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এ প্রবণতা রোধে দরকার সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো। তবে এই উপজেলায় এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কোনো কর্মসূচি তো নেই-ই, এই প্রবণতা সম্পর্কে জানেও না সরকারি প্রশাসন। আত্মহত্যার এই সংখ্যা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোন্দকার ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘সংখ্যা যে এত বেশি তা জানতাম না।’ তিনি বলেন, ‘এটি নতুন একটি ইস্যু। এর বিষয়ে খোঁজখবর নেব।’ এ বছরের সাত মাসে আত্মহত্যা করেছে—এমন ১২ জনের মধ্যে আটজনই স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। আর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া ৯৮ জনের মধ্যে ৪৯ জনই শিক্ষার্থী। এর পাশাপাশি গৃহিণী ২১ জন, বেকার পাঁচজন, কৃষক সাতজন, ব্যবসায়ী আটজন, দিনমজুর পাঁচজন ও অসুস্থ তিনজন। এ বছর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে—এমন নয়জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এর মধ্যে ছয়জনই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, একজন কৃষক এবং দুজন গৃহবধূ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে চারজন ছাত্রী। শৌখিনপাড়ার এক কলেজছাত্র (১৮) বলেন, ‘আমি ঢাকার একটি কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। মা-বাবা রাজি না হওয়ায় অভিমান করে বিষ খেয়েছিলাম।’ আরেক ছেলে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার চেষ্টার কারণও বাবা-মায়ের প্রতি অভিমান। মেয়ে শিক্ষার্থীদের ভেতর দুজন প্রেমের সম্পর্কের কারণে, একজন মুঠোফোনে কথা বলতে বারণের কারণে এবং অপরজন লেখাপড়া নিয়ে বাবা-মায়ের গালিগালাজের কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে দুই নারীর একটি পরিবার দারিদ্র্য ও অপরটি পারিবারিক অশান্তির কথা বলেছে। জর্দার কৌটা ফেলে দেওয়ায় শেখেরহাট গ্রামের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী আনজুয়ারা খাতুনকে (৯) বকুনি দেন মা। অভিমানে শিশুটি ঘরের আড়ার সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ে। মা মোস্তাকিমা বেগম বলছিলেন, ‘মেয়েটা খুব অভিমানী ছিল। তবে সামান্য বকাঝকায় যে আত্মহত্যা করবে, তা কখনো ভাবিনি।’ আত্মহত্যার প্রবণতা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাত্ত্বিকভাবে আত্মহত্যার কারণ হলো সংহতি নষ্ট হওয়া। সেটা পরিবারে হতে পারে, হতে পারে সমাজে।’ আত্মহত্যাকারীদের বয়স, শ্রেণি-পেশা এবং ধরন সম্পর্কে জানালে জিয়া রহমান বলেন, ‘জাতীয়ভাবে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যেও অল্প বয়সীদের সংখ্যাই বেশি। আমাদের প্রথাগত সমাজের সঙ্গে বিকাশমান অর্থনীতি ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের একটি দ্বন্দ্ব চলছে। নতুন নতুন মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে। নারী-পুরুষের সম্পর্কের ধরনও পাল্টাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তারে মুক্ত সম্পর্কের চর্চাটা কিশোর-কিশোরীরা বাইরে যতটুকু করতে পারছে, বাড়িতে তা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই বাধা অল্প বয়সী মন হয়তো মেনে নিতে পারছে না।’ আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে সচেতনতা বাড়ানোকে সবচেয়ে বেশি দরকার বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহিত কামাল। তিনি বলেন, ‘সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা যেমন আমাদের কম, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কেও ধারণা কম।’ বদরগঞ্জে আত্মহত্যাকারী ও চেষ্টাকারীদের বেশির ভাগই কীটনাশক খেয়েছে। এভাবে আত্মহত্যার উপাদান সহজপ্রাপ্য হওয়ায় ওই অঞ্চলে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন মোহিত কামাল। বদরগঞ্জ উপজেলা সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোবিন্দ কুণ্ডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীটনাশক বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। আমরা যেকোনো ক্রেতার কাছে তা বিক্রি করতে পারি।’ তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ‘কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় আমার কাছে একটি মেয়ে সবজির বাগানে দেবে বলে কীটনাশক চায়। সন্দেহ হওয়ায় আমি দিইনি। পরে জেনেছি, মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল বিষ খেয়ে।’ ব্যবসায়ীদের জেনে-বুঝে কীটনাশক বিক্রি করার পরামর্শ দেন তিনি। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টাকারীকে সর্বোচ্চ এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। এ ছাড়া তাদের অর্থদণ্ডও দেওয়া যায়। তবে বদরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মামুন অর রশিদ বলেন, গত সাত মাসে একজন চেষ্টাকারীর বিরুদ্ধেও কোনো মামলা হয়নি।

No comments:

Post a Comment