Saturday, September 20, 2014

প্রতারণা করে সাড়ে তিন একর জলাশয় দখল:কালের কন্ঠ

গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার মধ্য ভাংনাহাটি গ্রামে ৩ দশমিক ৫৭ একর জমির ওপর একটি খাস (সরকারের অধিকারভুক্ত) জলাশয় ফকির শিল্প গ্রুপ দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই শিল্প গ্রুপের গ্রীনভিউ রিসোর্টের পাশে রয়েছে জলাশয়টি, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২২ কোটি টাকা। এক মাস ধরে সীমানা বেষ্টনী দিয়ে জলাশয়টিকে গ্রীনভিউ রিসোর্টের সঙ্গে যুক্ত করে নেয় ফকির শিল্প গ্রুপ। ফলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় জলাশয়ের পারের
কবরস্থান, উচ্ছেদ করা হয় ১৪টি ভূমিহীন পরিবার। এ ছাড়া কয়েক শ ফলদ গাছ কেটে রোপণ করা হয় সৌন্দর্যবর্ধক গাছ। গ্রামবাসী সূত্রে জানা যায়, এর আগে দীর্ঘকাল ধরে জলাশয়টি ইজারা নিয়ে মৎস্য চাষ করছিল গ্রামের সমবায়ী মৎস্যচাষিরা। কিন্তু ৯ মাস আগে মৎস্যচাষিদের সমিতির নাম জালিয়াতি করে একই নামে জলাশয়টি ইজারা করে নেয় দখলকারীরা। দেখা যায়, ওই সমিতির সদস্যরা ফকির শিল্প গ্রুপের গ্রীনভিউ রিসোর্টের কর্মচারী। তারা কেউ স্থানীয় নয়। সমিতির ২০ সদস্যের মধ্যে  ১৭ জনেরই বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায়।  গ্রামবাসী জানায়, ফকির শিল্প গ্রুপের মালিক ফকির মো. মনিরুজ্জামান তাঁর কর্মচারীদের দিয়ে ইজারা নাটকের মাধ্যমে দখল করে নিয়েছেন জলাশয়টি। স্থানীয় প্রশাসন মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে এ দখলবাজিতে সহযোগিতা করেছে। তারা আরো জানায়, প্রায় ১০ থেকে ১১ বছর আগে ফকির শিল্প গ্রুপের মালিক ফকির মো. মনিরুজ্জামান শ্রীপুরের মধ্য ভাংনাহাটি গ্রামে গ্রীনভিউ নামে একটি রিসোর্ট করেন। খাস জলাশয়টি ওই রিসোর্ট-ঘেঁষা। ফলে রিসোর্টের জলাশয়মুখী একটি বহির্দ্বার রাখেন তিনি। কয়েক বছরের ব্যবধানে জলাশয়-ঘেঁষা পশ্চিম পাশে আরো কিছু জমি কেনেন মনিরুজ্জামান। পরে ধীরে ধীরে জলাশয় দখল করে নেন। জলাশয়ের মৎস্যচাষিরা জানায়, প্রায় ছয় বছর আগে তারা মধ্য ভাংনাহাটি সমবায় সমিতি করেছিল। ওই সমিতির নামে জলাশয়টি ইজারা নিয়ে তারা মৎস্য চাষ করে আসছিল। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর একই সমিতির নামে জলাশয়টির ইজারা হয়। কিন্তু তারা তা জানতে পারেনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই নামে গ্রীনভিউ রিসোর্টের কর্মচারীরা আরো একটি সমিতি করেছে। ওই সমিতির নিবন্ধন নম্বর ৩৬৬। সমিতির নিবন্ধনপ্রাপ্তি, কার্যকরী পরিষদের নির্বাচন ও খাস জলাশয় ইজারা দেওয়া হয় একই তারিখে। সমবায় বিধিতে উল্লেখ রয়েছে, উপজেলার বাইরের কোনো সদস্য থাকলে সমিতির নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা যাবে না। এ বিষয়ে জানতে শ্রীপুর উপজেলা সমবায় অফিসে যোগাযোগ করা হলে অফিস সহকারী আবু রায়হান বলেন, ‘এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কোনো তথ্য দিতে কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে।’ তবে শ্রীপুর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ মৃধা বলেন, ‘পৌরসভার মেয়রের সনদ থাকায় সদস্যদের শ্রীপুর উপজেলার বাসিন্দা মনে করে সমিতি নিবন্ধন করেছিলাম।’ কিন্তু শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান বলেন, ‘শ্রীপুরের বাসিন্দা নয়- এমন কাউকে আমি সনদ দিইনি।’ তবে সরেজমিনে গিয়ে ওই সমিতির কার্যালয় ও সাইনবোর্ড পাওয়া যায়নি। সমিতির সদস্য মো. আতাবর বলেন, ‘গ্রীনভিউ রিসোর্টই আমাদের সমিতির কার্যালয়।’ যেভাবে দখল করা হয় জলাশয়টি:  মাত্র ৪০ হাজার টাকায় তিন বছর মেয়াদের জন্য ইজারা নেয় মধ্য ভাংনাহাটি সমবায় সমিতি। ইজারা নেওয়ার পর দীর্ঘ আট মাস জলাশয়ে কোনো মৎস্য চাষ করেনি সমিতির সদস্য গ্রীনভিউ রিসোর্টের কর্মচারীরা। গ্রামবাসী জানায়, এক মাস আগে গ্রীনভিউ রিসোর্টের কর্মচারীরা দাবি করে, তাদের মালিক জলাশয়টি ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন। পরে স্থানীয় দখলকারীরা জলাশয়ের পার থেকে ১৪টি ভূমিহীন পরিবারকে উচ্ছেদ করে। উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ভূমিহীন ইদ্রিস আলী জানান, গ্রীনভিউ রিসোর্টের মালিক ফকির মো. মনিরুজ্জমান তাঁদের প্রত্যেক পরিবারকে নগদ দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে উচ্ছেদ করেছেন। মকবুল হোসেন নামে গ্রামের এক কৃষক জানান, জলাশয়ের কেটে ফেলা ফলদ গাছগুলোর মূল্য হবে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। পরে চারপাশে মাটি ভরাট করে জলাশয়ের পরিসর ছোট করে ফেলা হয়। পারে থাকা একটি কবরস্থানও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় কর্মচারীরা। ভূমিহীনরা আরো জানায়, কবরস্থানে ৪৫-৫০টি কবর ছিল। বাড়িঘর ভেঙে তাদের উচ্ছেদের পর কবরস্থানটি ভেঙে না ফেলার আকুতি জানিয়েছিল তারা। এতে তাদের জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়। ভূমিহীন শ্রমিক আবুল কাশেম বলেন, ‘পূর্বপুরুষদের কবর ভাঙার সময় মনে অয়েছিল মাস্তানরা যেন আমার বুকটার মধ্যে কুবাইতাছে। ডরে কিছু কইতারছি না।’ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জলাশয়ে এখনো মাটি ভরাটের কাজ চলছে। পাশেই নিরাপত্তাকর্মীরা। বাইরের কারো বেষ্টনীর ভেতর প্রবেশের অনুমতি নেই। জলাশয় দখল বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের মালিক এটা ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন।’ গ্রীনভিউ রিসোর্টের ব্যবস্থাপক ও মধ্য ভাংনাহাটি সমবায় সমিতির সভাপতি গাজী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়মমাফিক জলাশয় ইজারা নিয়েছি। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে সদস্যরা সীমানা বেষ্টনী ও গাছ রোপণ করলেও দখল উদ্দেশ্য নেই।’ তবে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিল্প গ্রুপের মালিক ফকির মো. মনিরুজ্জামানের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে কখনো তিনি ফোন ধরেননি, কখনো বা ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। শ্রীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজমুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ‘স্থানীয় সমবায় সমিতির নামে ইজারা নিয়ে জলাশয়ের চারপাশে সীমানা প্রাচীরসহ স্থাপনা করার বিধান নেই।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদেকুর রহমান বলেন, ‘দখলবাজির অভিযোগ পেয়ে তিন দিনের মধ্যে সব স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। সরিয়ে না নেওয়া হলে দখলকারীদের উচ্ছেদ করা হবে।’ এ বিষয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নূরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জলাশয় দখলের অভিযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিক উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছি। সব শর্ত ভঙ্গ করায় ওই সমবায় সমিতির ইজারা বাতিল করা হবে। তা ছাড়া ওই সমিতি ইজারা পাওয়ার যোগ্য কি না, তা যাচাই করে দেখা হবে।’

No comments:

Post a Comment