রাজধানীর কুড়িল-বিশ্বরোড রেলক্রসিং ও কুড়িল উড়ালসড়কের নিচের বিমানবন্দর সড়কে গত ১০ মাসে ৩৫ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ২৫ জন রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায়, ১০ জন রেলক্রসিং পার হয়ে বিমানবন্দর সড়ক অতিক্রম করতে গিয়ে অথবা বিমানবন্দর সড়ক পার হয়ে রেলক্রসিংয়ের দিকে আসার সময় গাড়িচাপায় প্রাণ হারান। রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। রেলওয়ে পুলিশের কমলাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
(ওসি) আবদুল মজিদ জানান, কুড়িলে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারানো ২৫ জনের মধ্যে একজন ছিনতাই করে পালাতে গিয়ে কাটা পড়েন। বাকি ২৪ জনই ছিলেন পথচারী। রাজধানীর কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার রেলপথ আছে। এই পথের খিলগাঁও, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, বনানী ও কুড়িল রেলক্রসিং এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে। রেলওয়ে পুলিশের হিসাবে, এই পথে গত ১০ মাসে ১৪০ জন ট্রেনে কাটা পড়ে কিংবা ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মারা গেছেন। বেশির ভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে রেলক্রসিংগুলোতে। কুড়িল উড়ালসড়ক হওয়ার আগে প্রগতি সরণি থেকে বিমানবন্দর সড়কে ওঠার এবং বিমানবন্দর সড়ক থেকে প্রগতি সরণিমুখী যানবাহন এই রেলক্রসিং দিয়ে পারাপার হতো। উড়ালসড়ক হওয়ার পর ক্রসিংটির দুই পাশে স্থায়ী লোহার বেড়া দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে পথচারীরা এই বেড়ার ফাঁক গলে ক্রসিং পারাপার হয়। রেলওয়ে সূত্র জানায়, কুড়িল রেলক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৯০টি ট্রেন চলাচল করে। আর বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে কয়েক হাজার যানবাহন চলাচল করে। কুড়িলের বাসিন্দা ও এই পথ ধরে প্রতিদিন উত্তরার আজমপুর চলাচলকারী রবিউল আলম বলেন, ‘এ জায়গায় পদচারী সেতু (ফুটওভারব্রিজ) না থাকায় পথচারীদের জন্য তা মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। মানুষ সতর্ক থাকবে, কিন্তু সেটারও তো একটা মাত্রা আছে। এখানে তো সড়ক ও রেললাইন দুটিই বিপজ্জনক।’ স্থানীয়রা জানান, এই পথ ধরে রাজধানীর বাড্ডা, কাজীবাড়ী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, কালাচাঁদপুর, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ বিমানবন্দর সড়কে আসে। আবার সেনানিবাস, নিকুঞ্জ, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ রেললাইন পার হয়ে প্রগতি সরণির দিকে যায়। এদের একটা বড় অংশই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। বি এ এফ শাহীন কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ, শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজ, শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ঝুঁকি নিয়ে এই পথে পারাপার হয়। এখানে দুটি পদচারী সেতুর কাঠামো তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু এখনো পাটাতন বসানো হয়নি। পথচারীরা বলছেন, এটা হলে ঝুঁকি কিছুটা কমত। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক কুড়িল উড়ালসড়কের পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি গতকাল শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, কুড়িল উড়ালসড়ক প্রকল্পে পথচারীদের জন্য যেসব সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল, সেগুলো হয়নি। এ জন্যই পথচারীরা মারা পড়ছেন। তিনি জানান, পরিকল্পনায় ওই স্থানে দুটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের কথা ছিল। পরে তিনটি ফুটওভার ব্রিজ করার সিদ্ধান্তও হয়েছিল। এগুলো এমনভাবে নকশা করা হয়েছিল, যাতে সড়কের মাঝখানে কোনো খুঁটি না পড়ে। পুরোটাই স্টিল ফ্রেমের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কয়েকটি খুঁটি বসানো হলেও কাজটি শেষ করা হয়নি। রেলক্রসিংটি কেন ঝুঁকিপূর্ণ: রেলওয়ে সূত্র জানায়, ক্রসিংয়ের কাছে রেললাইনটি ৩ ডিগ্রি বাঁকানো। এই মাত্রার বাঁক রেলের ভাষায় ‘বড় বাঁক’ হিসেবে চিহ্নিত। এই বাঁকে চলন্ত ট্রেনের সামনের বগির যাত্রীরা জানালা দিয়ে মাথা বের করে পেছনে তাকালে একেবারে শেষ বগি পর্যন্ত দেখতে পারেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, এই বাঁকের কারণে ক্রসিং দিয়ে পার হওয়া লোকজন সরাসরি ট্রেন দেখতে পান না। ফলে হঠাৎ ট্রেন কাছে এসে পড়ে। বাঁকের পাশাপাশি রেললাইন ঘেঁষে রয়েছে গাছপালা, অবৈধ দোকানপাটও। ফলে পথচারীরা রেললাইনে উঠে মাঝ বরাবর গিয়ে টের পান ট্রেন আসছে। তখন অনেকে আর সামনে বা পেছনে সরে যাওয়ার সুযোগও পান না। পতিত হন দুর্ঘটনায়। শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মাসুদ রানা এবং বি এ এফ শাহীন কলেজের একই শ্রেণির মাহমুদুন্নী প্রথম আলোকে বলে, সড়ক থেকে রেললাইনে ওঠার সময় ট্রেন আসছে কি না, তা দেখার কোনো জো নেই। যানবাহনের হর্ন ও প্রচণ্ড শব্দের কারণে ট্রেনের হুইসেল বা আওয়াজও শোনা যায় না। ফলে একটু অসতর্ক হলেই জীবনের ঝুঁকি। ক্রসিংয়েই মুখেই সড়কের ওপর চকি বসিয়ে কাপড় বিক্রি করেন হায়দার আলী খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে চোখের সামনে এক যুবক মারা গেলেন। শেষ মুহূর্তে যুবকটি টের পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ধারণা করেছিলাম, নিরাপদে পিছিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু ট্রেন চলে যাওয়ার পর রক্তাক্ত দেহটি পড়ে ছিল।’ রেলওয়ে পুলিশের কমলাপুর থানার ওসি আবদুল মজিদ বলেন, পার্বত্য বান্দরবানে রাস্তার বাঁকে যানবাহন যাতে নজরে পড়ে সে জন্য আয়না লাগানো হয়েছিল। কুড়িলেও পথচারীদের জন্য এই ব্যবস্থা করলে ট্রেনে কাটা পড়ার হার কমতে পারে। ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পার: রেলক্রসিংটি পার হয়ে বিমানবন্দর সড়কে এসে অথবা বিমানবন্দর সড়ক পার হয়ে প্রগতি সরণিতে আসার সময় রাস্তায় দ্রুতগতির গাড়ির চাপায় পড়ে গত ১০ মাসে মারা গেছেন ১০ জন। খিলক্ষেত থানা সূত্র আরও জানায়, কুড়িল ক্রসিংয়ের কাছে এভাবে সড়ক পারাপারের কারণে গত ১০ মাসে ৩০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় অন্তত ১০ জন মারা যান। আহত হন অনেকে। খিলক্ষেত থানার ওসি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বেপরোয়া গতির যান ও পথচারীদের অসতর্কতাই এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। ঢাকা মহানগর পুলিশের হিসাবে, রাজধানীর ৫৪টি মোড়ে প্রাণহানির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব মোড় ও সড়ক বিভাজকের কাটা অংশ দিয়ে পথচারীরা পারাপার হতে গিয়েই বেপরোয়া ও দ্রুতগতির যানবাহনের নিচে চাপা পড়েছেন। রাজধানীতে ২০১২ সালে ৩৬৭ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এর মধ্যে ২৫৪ জনই পথচারী। কুড়িল ক্রসিংয়ে ট্রাফিক পুলিশের একটি বক্স আছে। সেখানকার এক সদস্য বলেন, তিনি ঘড়ি ধরে হিসাব করে দেখেছেন, এই সড়ক দিয়ে ব্যস্ত সময় প্রতি মিনিটে গড়ে ১৫০টি যানবাহন চলে। এর মধ্যেই মিনিটে গড়ে ২০-২৫ জন পথচারী হাঁত উঁচিয়ে, গাড়ি থামিয়ে, শরীরের নানা কসরত করে পারাপার হন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সামছুল হক জানান, কুড়িল উড়ালসড়ক প্রকল্প-পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, ফুটওভারব্রিজ করার পর যাতে কেউ আর উড়ালসড়কের নিচ দিয়ে বিমানবন্দর সড়ক পার না হতে পারে, সে জন্য বিদ্যমান সড়ক বিভাজকের উচ্চতা সাড়ে তিন ফুট থেকে বাড়ানো হবে। সূত্র জানায়, ৩০৬ কোটি টাকার কুড়িল উড়ালসড়কটি তড়িগড়ি করে গত বছর উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর ফুটওভারব্রিজ নির্মাণসহ প্রকল্পের ছোটখাটো কিছু কাজ রয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment