Wednesday, October 22, 2014

বেপরোয়া গতি, চালকের জন্যই ৯১% দুর্ঘটনা:প্রথম অালো

মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয় যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং পথচারীদের চাপা দেওয়ার ঘটনায়। রাজধানী ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারায় পথচারীরা। এসব দুর্ঘটনার ৯১ শতাংশই ঘটে অতিরিক্ত গতিতে বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর কারণে। গত সোমবার নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩৪ জন প্রাণ হারান। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে
। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) ১৪ বছরের (১৯৯৮ থেকে ২০১২ সাল) তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। এআরআই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি প্রতিষ্ঠান। দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত পুলিশের সংগ্রহ করা তথ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা করে এবং তথ্যভান্ডার তৈরি ও ক্ষেত্রবিশেষে সরেজমিনে প্রতিবেদন তৈরি করে। দুর্ঘটনার পর প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) কিংবা মামলা হলেই কেবল পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করে। এর বাইরের দুর্ঘটনার তথ্য সরকারি হিসাবে থাকে না। পুলিশ যে ছকে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে, তাতে ১৮টি ঘর থাকে। এতে ১১ ধরনের দুর্ঘটনার উল্লেখ থাকে। গত ১৪ বছরে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৯ হাজার ৭৭৭টি। এর মধ্যে পথচারীদের চাপা দেওয়ার ঘটনা ২২ হাজার ৩৫৫টি। আর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে সাত হাজার ৫৪৩ বার। তবে মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি। এআরআইয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সব ধরনের দুর্ঘটনাতেই নিহত ব্যক্তিদের কয়েক গুণ আহত হয়েছেন। ঢাকার রাস্তা পথচারীদের জন্য মৃত্যুফাঁদ: পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে রাজধানী ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৬৭ জন মারা যান। এর মধ্যে ২৫৮ জনই পথচারী। অর্থাৎ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ পথচারী। এসব মৃত্যুর ৭২ শতাংশই ঘটেছে মোড়গুলোতে। এটাই পুলিশের করা সর্বশেষ হিসাব। বুয়েটের এআরআই রাজধানীর ৫৪টি মোড়কে দুর্ঘটনার জন্য বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করেছে। ২০১২ সালে করা এক সমীক্ষায় এসেছে, ১৯৯৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঢাকার এই মোড়গুলোতে দুই হাজার ৪২৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ মোড় হচ্ছে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার মোড়, বিজয় সরণি, তোপখানা থেকে পুরানা পল্টন মোড় ও সায়েদাবাদ মোড়। অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া চালকই দায়ী বেশি: এআরআই বিশ্লেষণ অনুসারে, গত ১৪ বছরে সারা দেশে ৪৯ হাজার ৭৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ৯১ শতাংশই অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া চালনার জন্য হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা যায় ৪২ হাজার ৫২৬ জন। অবশ্য বেসরকারি হিসাবে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানির পরিমাণ অনেক বেশি। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদের ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করে। তাদের হিসাবে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসেই তিন হাজারের বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনায় মারা যান তিন হাজার ৭৭০ জন। গাড়ির গতিবেগ মেপে অতিরিক্ত গতির জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হাইওয়ে পুলিশকে স্পিডগান সরবরাহ করেছে সরকার। কিন্তু অভিযোগ হচ্ছে, পুলিশ সেটা ব্যবহার করে না। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামে একটি বেসরকারি সংগঠনও। এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন দুর্ঘটনা নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছেন একাধিকবার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পেছনে চারটি বড় কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, চালকের স্থায়ী নিয়োগের বদলে যাত্রার ওপর বেতন নির্ধারণ, শাস্তির অপ্রতুলতা এবং হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালালে যানবাহন মালিকও খুশি হন। কারণ, তাতে ট্রিপ বাড়ে। একই কারণে চালকের আয় বৃদ্ধি পায়। ক্ষেত্র বিশেষে চালক যাত্রীদেরও বাহবা পান। এ জন্যই চালকেরা উৎসাহী হয়ে গাড়ির গতি বাড়ান এবং দুর্ঘটনা ঘটে। এতে চালকের প্রাণহানিও ঘটে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সরকারকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘মানছি, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব আছে। তাহলে সরকার কেন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না? হাইওয়ে পুলিশের তো যন্ত্র আছে। তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন? আসলে চালকেরা মুনাফাবাজির শিকার।’ গতি নিয়ন্ত্রণ হয় না: মোটরযান আইনে যানবাহনের জাতীয় গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। জাতীয় মহাসড়ক এবং শহর ও লোকালয়ের জন্য আলাদা গতিসীমা রয়েছে। মহাসড়কে বাস, কোচ ও পিকআপের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা আছে ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার। ভারী ট্রাক ও লরির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়ির সর্বোচ্চ গতি ১১০ কিলোমিটার। শহর ও লোকালয়ে সব যানবাহনেরই গতিসীমা আরও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে বাস, কোচ, পিকআপ, ভারী ট্রাক, লরির সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও ভারী যানবাহন ২০ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়ির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। অবশ্য সড়ক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে নির্দিষ্ট স্থানে মোটরযান আইনের এই গতিসীমা কম-বেশি করতে পারে। কিন্তু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা আইনে উল্লেখ করা গতিসীমা কোনোটাই চালকেরা মেনে চলেন না। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছরে তিনি বহুবার যন্ত্র ব্যবহার করে যানবাহনের গতিসীমা মেপেছেন। টের পেয়ে অধিকাংশ চালকই গতি কমিয়ে দেন। তবে এর পরও নির্ধারিত গতির চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি গতিতে যানবাহন চালাতে দেখা গেছে। তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার মূল কারণের বাইরে আরও অনেক কারণ থাকে। উন্নত বিশ্বে এসব কারণ বের করে সমাধানের জন্য সরকারের আলাদা বিভাগ রয়েছে। বাংলাদেশে পুলিশের সেই ধরনের দক্ষতা নেই। ফলে অনেক কারণ ও সমাধান অজানা থেকে যায়। হাইওয়ে পুলিশের গতি মাপার কিছু যন্ত্র আছে। তবে তা ব্যবহার করে যানবাহন চালককে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার নজির কম। জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক এস এম কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত গতি মাপার যন্ত্র হাইওয়ে পুলিশের সব স্থানেই আছে। গতি না মানার দায়ে প্রতিদিনই মামলা দেওয়া হয়। একাধিক চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাস ও ট্রাকের প্রায় সব চালকই মাসিক বেতনভুক্ত নন। যাত্রা (ট্রিপ) অনুযায়ী মালিকের কাছ থেকে টাকা পান। এ জন্যই পথে গতি বৃদ্ধি করে পাল্লা দিয়ে যানবাহন চালান তাঁরা। এতেই দুর্ঘটনা ঘটে। সামছুল হক বলেন, বাণিজ্যিক চালকেরা বাধ্য না হলে গতি কমাবেন না। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকায় নিজের মৃত্যুঝুঁকি থাকার পরও তাঁরা পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালান। এটা বন্ধ করতে হলে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি ও চালকের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

No comments:

Post a Comment