Wednesday, October 22, 2014

শোকের গ্রাম সিধুলীতে এক কবরস্থানে ১৪ জনের দাফন:প্রথম অালো

দুবাই থেকে দুই বছর পর গত সোমবার বাড়ি ফিরেছেন মাজেদুল ইসলাম। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার সিধুলী মধ্যপাড়া গ্রামে। এসে শুনলেন বাবা আবুল কালাম আজাদ নাটোর গেছেন আদালতে হাজিরা দিতে। সেই বাবা আর ফিরে এলেন না। খুঁজতে খুঁজতে এক দিন পর গতকাল মঙ্গলবার মর্গে পেলেন বাবার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। এরপর মাজেদুল ইসলামের যে অবস্থা, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিধুলী মধ্যপাড়ায় তাঁদের বাড়িতে গিয়ে
দেখা গেল, কান্নার রোল উঠেছে। কেবল তাঁদের বাড়িতেই নয়, পুরো গ্রামটিতেই চলছে মাতম। সোমবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বড়াইগ্রাম উপজেলার রেজ্জেকের মোড় এলাকায় বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে মুখোমুখি দুই যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষে যে ৩৪ জন নিহত হন, তাঁদের ১৪ জনই এই গ্রামের। এই ১৪ জনের মধ্যে আবার ছয়জন সহোদর। দুর্ঘটনার পর থেকেই গ্রামটি মুহ্যমান হয়ে আছে শোকে। উঠানে লাশ নিয়ে রাত কাটিয়েছে তারা। গতকাল দিনের প্রথম ভাগ কেটেছে দাফন-কাফনের কাজে। শান্ত-সবুজ গ্রামের ভেতর দিয়ে লাশের পর লাশ কাঁধে নিয়ে চোখের পানিতে হয়েছে শবযাত্রা। পাশাপাশি খোঁড়া ১২ কবর। তাকালে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে পোড় খাওয়া সংবাদকর্মীরও।  নিহত ছয় ভাইসহ নিহত ১২ জনকে গতকাল সিধুলী কবরস্থানে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়।  সকাল ১০টায় কবরস্থানসংলগ্ন সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জানাজা পড়ানো হয়। গুরুদাসপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা জরুহুল ইসলাম জানাজা পড়ান। স্থানীয় সাংসদ আবদুল কুদ্দুসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী জনপ্রতিনিধিসহ কয়েক হাজার মানুষ জানাজায় অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন আক্তার। খাটিয়ায় করে সারিবদ্ধভাবে লাশগুলো যখন জানাজার জন্য আনা হচ্ছিল, তখন স্বজনদের কান্নায় শোকবিহ্বল হয়ে ওঠে গ্রামের পরিবেশ। বিকেলে আসে আবুল কালাম আজাদ ও বাহাদুরের লাশ। ১২ জনের পাশেই খোঁড়া হয় তাঁদের কবর। একই শোক-শ্রদ্ধায় তাঁদের চির বিদায় জানায় গ্রামবাসী। নিহত এই ১৪ জনই ছিলেন একটি হত্যা মামলার আসামি। বছর দেড়েক আগে এই গ্রামের খায়রুল ইসলাম ও আমির হোসেন নামের দুই ভাই জমিজমার বিরোধ নিয়ে খুন হয়েছিলেন। তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে গ্রামের ২৭ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। নাটোর আদালতে এই মামলায় হাজিরা দিয়ে ওই ২৭ জন গুরুদাসপুরের বাড়িতে ফিরছিলেন। নিহত১৪ জনের মধ্যে ছিলেন ছয় ভাই‍—আতাহার হোসেন, রায়হান আলী, রব্বেল আলী, সোহরাব হোসেন, সাইর উদ্দীন ও কইর উদ্দিন। তাঁরা সাত ভাই। সবাই এই মামলার আসামি। অন্যজন আক্কু গুরুতর আহত অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এই গ্রামের নিহত অপর আটজন হলেন আবুল কালাম আজাদ, এবাদ আলী, লাবু, শরিফ উদ্দীন, আলমগীর হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন, আয়নাল ও বাহাদুর।  মর্গে মিলল বাবার লাশ: সোমবার রাতেই কারও কারও লাশ তাঁদের বাড়িতে আনা হয়েছিল। পাওয়া যাচ্ছিল না আবুল কালাম আজাদের কোনো খবর। প্রবাসে দুই বছর কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে সোমবার দুপুরে বাড়ি এসে পৌঁছান তাঁর ছেলে মাজেদুল ইসলাম। সন্ধ্যায় দুর্ঘটনার খবর পেয়ে খোঁজ নিতে শুরু করেন। যে মৃতদেহগুলো সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শুকুর আলীর বাড়িতে এনে উঠানে সারি দিয়ে রাখা হয়েছিল, তার মধ্যে আবুল কালাম আজাদের লাশ ছিল না। ফলে আশায় বুক বেঁধে ছিলেন তিনি, বাবা হয়তো বেঁচে আছেন। গতকাল হাসপাতালে আহতদের মধ্যেও খুঁজে না পেয়ে অবশেষে নাটোর সদর হাসপাতালের মর্গে গিয়ে পেলেন বাবার মৃতদেহ। বাবার সঙ্গে কথা হলো না আর। হবেও না কোনো দিন। রাতে ভাত খায়নি শামিম: সোমবার রাতে ভাত খায়নি সাত বছরের শামিম। সোমবার সকালে ওর বাবা কইর উদ্দিন যখন বাড়ি থেকে বের হন, তখন সে আবদার করে তিলের খাজা আনার। সকাল গড়িয়ে রাত। বাবা ফেরেননি। অপেক্ষায় থেকে থেকে না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে সে। গতকাল সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখে উঠানে বাবার লাশ। কইর উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর অন্য পাঁচ ভাইয়ের লাশও রাতেই আনা হয়েছিল তাঁদের বাড়িতে। উঠানে সারি দিয়ে রাখা। বাড়িতে চলছে মাতম।  শামিমের মা বিউটি আর বড় বোন শারমিন পাগলপ্রায়। প্রতিবেশীরা তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। শামিম তার খালা আদুরির কোলে। তিনি জানান, শামিম ছিল ওর বাবার খুব আদরের। সংসারে অভাব-অনটন থাকলেও শামিমের কোনো আবদার তিনি অপূর্ণ রাখতেন না। বাবা তিলের খাজা আনবে—এ আশায় থেকে রাতে ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে। পাশের বাড়ি তোফাজ্জল হোসেনের। তাঁর স্ত্রী শীলা দুই মেয়ে পাঁচ বছরের তৃপ্তি আর তিন বছরের তমাকে আঁকড়ে ধরে বিলাপ করছেন। তোফাজ্জল সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নকলনবিশের চাকরি করতেন। সেই আয়েই বিধবা বোন, বৃদ্ধ মাসহ ছয়জনের সংসার চলত। তাঁর স্ত্রী বারবার বলছিলেন ‘এখন অবুঝ এই সন্তানদের কী হবে?’ সিধুলী গ্রামের বাসিন্দা ও ধারাবারিষা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শুকুর আলী জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় সিধুলী গ্রামের যে ১৪ জন মারা গেছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। নিম্ন আয়ের মানুষ। তাঁদের অকালমৃত্যুতে পরিবারগুলোর কষ্টের শেষ থাকবে না। শোকের গ্রামে মন্ত্রী: সোমবার দিবাগত রাত প্রায় একটায় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সিধুলী গ্রামে আসেন। শুকুর আলীর বাড়ির উঠানে সারি দিয়ে রাখা নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ। মন্ত্রী তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করেন। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতিও সমবেদনা জানান তিনি। নিহত ব্যক্তিদের প্রতি পরিবারকে এক লাখ টাকা অনুদান এবং আহতদের সরকারি ব্যবস্থায় চিকিৎসার আশ্বাস দেন। এর আগে তিনি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

No comments:

Post a Comment