দিন শেষে তৃপ্তির হাসি গোটা বাংলাদেশ শিবিরে। সন্ধ্যার ম্লান আলোয় জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে আলো ছড়াচ্ছিল আরও একটা হাসি। সে হাসি কিউরেটর জাহিদ রেজার। হাসতে হাসতেই বলছিলেন, ‘আমি দোয়া করছিলাম, যেন বাংলাদেশ টসে জেতে...।’ তামিম ইকবাল-ইমরুল কায়েসের প্রত্যাবর্তন জুটিতে বাংলাদেশ দল কাল কতই না রেকর্ডের জন্ম দিল! ২০১০ সালে লর্ডসে নিজেদের ১৮৫ রান টপকে তামিম-ইমরুল গড়লেন বাংলাদেশের হয়ে উদ্বোধনী জুটিতে
সর্বোচ্চ ২২৪ রানের রেকর্ড। এক ইনিংসে তো বটেই, এক টেস্টেই বাংলাদেশের দুই ওপেনারের সেঞ্চুরি এই প্রথম। এর মধ্যে তামিম আবার ছুঁয়ে ফেললেন টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে মোহাম্মদ আশরাফুলের সর্বোচ্চ ছয় সেঞ্চুরির রেকর্ড। কিন্তু এই যে এত রেকর্ডের ছড়াছড়ি, স্কোর বোর্ডে ২ উইকেটে ৩০৩ রান রেখে টেস্ট ক্রিকেটে সেরা দিনগুলোর একটি কাটানো-এসব কিছুর পেছনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল টস জয়ের। মুশফিকুর রহিম টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছেন বলেই না ওই ব্যাটিং স্বর্গে আগে ব্যাট করার সুযোগ পেলেন তামিম-ইমরুল! উইকেটে বোলারদের জন্য এমনিতেই কিছু ছিল না। জিম্বাবুয়ের বোলাররাও পারেননি বাড়তি কিছু করে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলতে। কখনো কখনো তো বলের লাইন-লেংথই খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাঁরা। না, শুধু টস জয় আর বাজে বোলিংয়ের সৌজন্যেই এত কিছু হয়েছে বললে অবিচার হবে এই দুই ব্যাটসম্যানের প্রতি। ব্যাটিং উইকেট তো কতই হয়, সেটাকে কাজে লাগানোর সামর্থ্যও তো থাকতে হবে। আর বাজে বল মানেই সব সময় রান নয়, কখনো কখনো ওই বাজে বলেই বাজে শট খেলে আউট হয়ে যান ব্যাটসম্যানরা। তামিম-ইমরুল কাল সে রকম ভুল করলেনই না বলা যায়। দুই ওপেনারের বিদায়ের পর দিন শেষে উইকেটে ছিলেন মুমিনুল হক আর মাহমুদউল্লাহ। এর মধ্যে মুমিনুল ছিলেন টেস্টে আরও একটি ফিফটির অপেক্ষায় (৪৬*)। লাঞ্চের আগে ৯১ রান তুলে তামিম-ইমরুলের ফিফটির কাছাকাছি (তামিম ৪৪*, ইমরুল ৪১*) চলে যাওয়া কিংবা চা-বিরতির আগেই দুজনের সেঞ্চুরি, দলের রান ২১৩-এসব একটার পর একটা মেলালে জিম্বাবুইয়ান বোলারদের ওপর বাংলাদেশের দুই ওপেনারের শাসনের ছবিটাই শুধু ফুটে ওঠে। ২২৪ রানের জুটিতে ভুল একটাই। কিন্তু ভাগ্য ভালো, সে ভুলের মাশুল দিতে হয়নি। ব্যক্তিগত ১৯ রানের সময় নাতশাই মুশাঙ্গুয়ের বলে ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচ দিয়েও ব্রায়ান চারির পিচ্ছিল হাতের কল্যাণে বেঁচে যান ইমরুল। ইমরুল কায়েসের জন্য এটা প্রত্যাবর্তন টেস্ট। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের দলে থাকলেও অসুস্থতার কারণে দ্বিতীয় টেস্টে খেলা হয়নি। ছিলেন না জিম্বাবুয়ে সিরিজের প্রথম দুই টেস্টের দলেও। কিন্তু মাঝে বিসিবি একাদশের হয়ে কলকাতার এসকে আচার্য মেমোরিয়াল ট্রফিতে সেঞ্চুরি এবং শামসুরের ব্যর্থতা মিলে সুযোগ পান চট্টগ্রাম টেস্টের দলে। শুধু দলে ফেরা কেন, ইমরুল ফিরে পেলেন ওপেনিংয়ে নিজের জায়গাটাও। ২০১১ সালের অক্টোবরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ ওপেন করতে নেমেছিলেন। এরপর টেস্ট দলে সুযোগই পান এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কা সিরিজে। প্রত্যাবর্তন ম্যাচে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম সেঞ্চুরিটি পেলেও সেটি পেয়েছেন তিন নম্বরে নেমে। ওয়েস্ট ইন্ডিজেও সেখানেই খেলেছেন। তিন বছর পর আবার ওপেনিংয়ে তামিমের সঙ্গী ইমরুল এবং সেটিকে কী দারুণভাবেই না উদ্যাপন করলেন তিনি! ১৯১ বলে সেঞ্চুরি করেছেন ৯ বাউন্ডারি আর মুশাঙ্গুয়ের বলে দুই ছক্কায়, যার একটি আবার নার্ভাস নাইনটিজে গিয়ে। পরে বাউন্ডারি মেরেছেন আরও ৩টি। ইমরুলের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরিটি শেষ পর্যন্ত গিয়ে থেমেছে ১৩০ রানে মাসাকাদজার বলে গালিতে সিবান্দার ক্যাচ হয়ে। তামিম-ইমরুলের আগের জুটিগুলোতে তামিমকেই বেশি আক্রমণাত্মক মনে হতো। ইমরুল খোলস ছেড়ে বের হতেন আস্তে আস্তে। কিন্তু কাল দুজনে এগোচ্ছিলেন সমানতালে। পালা করে কখনো তামিম আক্রমণাত্মক হয়েছেন, কখনো বা ইমরুল। তবে ইমরুলের আগেই সেঞ্চুরি পেয়েছেন তামিম। দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনে খুলনায় দ্বিতীয় টেস্টের সেঞ্চুরিটাকে এগিয়ে রাখলেও তামিমের জন্য কালকের সেঞ্চুরির মহিমা অন্য রকম। নিজের শহর চট্টগ্রামে যে শতরানের দেখা পেলেন এই প্রথম! সেই শতরানও আবার কিছুটা পুরোনো তামিমের চেহারায় আবির্ভূত হয়ে। আগের টেস্টেই বাংলাদেশের পক্ষে মন্থরতম টেস্ট সেঞ্চুরি করার পর কাল ৮৮ বলে ফিফটি, সেঞ্চুরি ১৫০ বলে। ১৪ বাউন্ডারির সঙ্গে ছক্কা একটি। নার্ভাস নাইনটিতে গিয়ে চোখজুড়ানো সেই ছক্কাটি বোলার সিকান্দার রাজার মাথার ওপর দিয়ে। ২০১০ সালে লর্ডস আর ওল্ড ট্রাফোর্ডে পরপর দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন। গত টেস্টে প্রায় সাড়ে চার বছর পর সেঞ্চুরি পাওয়া তামিম টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরির আনন্দ উদ্যাপন করলেন আবারও। পার্থক্য শুধু এই-লর্ডস আর ওল্ড ট্রাফোর্ডের মতো শূন্যে লাফ দিয়ে নয়, এবারের উদ্যাপন নিজের শহরের দর্শকদের দিকে ব্যাট উঁচিয়ে। স্কোরকার্ড টস: বাংলাদেশ বাংলাদেশ ১ম ইনিংস রান বল ৪ ৬ তামিম ক হ্যামিল্টন ব রাজা ১০৯ ১৭১ ১৪ ১ ইমরুল ক অতি ব হ্যামিল্টন ১৩০ ২৫৭ ১২ ২ মুমিনুল ব্যাটিং ৪৬ ৮৮ ৩ ০ মাহমুদউল্লাহ ব্যাটিং ৫ ২৪ ০ ০ অতিরিক্ত (বা ২, লেবা ৫, ও ৬) ১৩ মোট (৯০ ওভারে, ২ উইকেটে) ৩০৩ উইকেট পতন: ১-২২৪ (তামিম, ৬৩.৫ ওভার), ২-২৭২ (ইমরুল, ৭৮.৬)। বোলিং: পানিয়াঙ্গারা ১৪-১-৪৬-০, চিগুম্বুরা ১০-৩-২৯-০ (ও ৪), শিঙ্গিরাই ১৫-৩-৫০-০ (ও ২), মুশাঙ্গুয়ে ২৫-৩-৮৫-০, রাজা ২১-০-৭৪-১, চারি ২-০-৯-০, হ্যামিল্টন ৩-১-৩-১।
No comments:
Post a Comment