Thursday, November 13, 2014

‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে...’:নয়াদিগন্ত

কিংবদন্তির কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় কথামালা ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে’র মতোই তিনি এখন পাঠকের নয়নে স্থান নিয়েছেন। বছর দুয়েক আগে ইন্তেকালের পর তাকে ছাড়া আজ পালিত হবে ৬৬তম জন্মবার্ষিকী। প্রথমবারের মতো তার মা আয়েশা ফয়েজও এ আয়োজনে থাকছেন না। তিনিও সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন।  হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উদযাপনে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ১২০০ মোমবাতির শিখায় গত রাতে আলোকিত হয়েছে তার প্
রিয় নূহাশপল্লী। গাজীপুরের পিরুজালীর এ নিভৃত পল্লীতেই শায়িত আছেন বাংলাদেশের পাঠকের নয়নতারাÑ কিংবদন্তির কথাশিল্পী। রাতেই কাটা হয়েছে কেক। আনন্দ আয়োজনও ছিল।  নূহাশপল্লীর ম্যানেজার বুলবুল নয়া দিগন্তকে বলেন, স্যারের জন্মদিনকে আমরা আনন্দময় করে তুলতেই এসব আয়োজন করেছি।  হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিতসহ আজ নূহাশপল্লীতে যাবেন। সেখানে তারা মায়ের সাথে বাবার কবর জিয়ারত করবেন বলে জানিয়েছেন বুলবুল।  ঢাকায় এ কিংবদন্তির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে তার একক গ্রন্থমেলা। এ ছাড়া যুক্ত হচ্ছে তার রচনাবলির অষ্টম খণ্ডের প্রকাশনা। বেলা ৩টায় পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে তার গ্রন্থের প্রকাশকেরা এ আয়োজন করেছেন। মেলা চলবে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।  গতকাল বুধবার জাতীয় জাদুঘরে তার স্মৃতি-নিদর্শন নিয়ে শুরু হয়েছে পক্ষকালব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী। চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে আজ থাকবে নানা আয়োজন। হিমু ভক্তরাও নূহাশপল্লীতে আয়োজন করেছেন উৎসবের।  ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনোয় জন্ম নেয়া হুমায়ূন আহমেদ বাবার কর্মস্থল পরিবর্তনের সুবাদে দেশর বিভিন্ন স্থানে জীবনের অনেকটা সময় কাটান। মুক্তিযোদ্ধা বাবার ছেলে হুমায়ূন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাস করে যুক্তরাষ্ট্রে ডক্টরেট করেন। এর আগে তিনি প্রথমে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তরুণ শিক্ষক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল বলে সে সময়কার সহকর্মীরা জানান।  ২০১১ সালের সেপ্টেস্বর মাসে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে যান হুমায়ূন আহমেদ। সেখানে ২০১২ সালের ১৬ জুলাই লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় ইন্তেকাল করেন। ‘নন্দিত নরকে’র পর হুমায়ূন আহমেদ নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন অল্প দিনে। বাংলাদেশে বইয়ের পাঠক সৃষ্টির কিংবদন্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে হুমায়ূন আহমেদকে। শুধু কথাশিল্পী নয়, নির্মাতা হিসেবেও তিনি সিদ্ধহস্ত। শিশুদের জন্যও প্রচুর লিখেছেন।   হিমু, মিসির আলী ও ফিহা তার তিনটি অনন্য সৃষ্ট চরিত্র। হিমু হলুদ পাঞ্জাবি তরুণদের প্রিয়। হিমু যুক্তি মানে না। অন্য দিকে মিসির আলী তার বিপরীত। যুক্তির নাটাইয়ে বাঁধা মিসির আলীর কাছে কখনো কখনো রূপসী তরুণীদের চেয়ে মাছিটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। ফিহা গাণিতিক সমীকরণে মিলান সব কিছু। এর বাইরেও তার অনেক সহজ স্বভাব সুলভ গল্প-উপন্যাস আছে।  ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটি দিয়ে তিনি মাতিয়ে তোলেন দর্শক। ওই নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি নিয়ে ঢাকায় মিছিল-সমাবেশ-অনশন পর্যন্ত হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ‘অয়োময়’ ও ‘বহুব্রীহি’র মতো নাটক লিখে তিনি ইতিহাস তৈরি করেছেন। নাটকের নক্ষত্র হয়ে আবির্ভূত হুমায়ূন আহমেদ ছবি নির্মাণে হাত দিলেন। ‘আগুনের পরশমণি’ ছবিটি বানিয়ে তিনি হুলস্থুল ফেলে দেন। কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পান এর জন্য। মুক্তিযুদ্ধ তার সাহিত্যে যেমন এসেছে, তেমনি তার বানানো নাটক ও ছবিতেও। তার নির্মিত ‘শ্যামল ছায়া’ পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।  সাহিত্যের সব শাখায় তিনি সৃষ্টি করেছেন রসবোধ। সাহিত্য নিরেট কাঠখোট্টা কোনো বিষয়Ñ এটা মানতে নারাজ হুমায়ূন আহমেদ। তার গল্প উপন্যাসে দুঃখ বোধের চেয়ে হাসি আনন্দটাই বেশি। নগর জীবনের কষ্ট, সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ, বেকারত্বের অভিশাপ, মানুষের বিচিত্র সব ইচ্ছা উঠে এসেছে তার লেখনিতে। মানুষের ভেতরের কথাগুলো তিনি সহজ করে বলেছেন।  হুমায়ূন আহমেদ গাজীপুরে গড়ে তোলেন নূহাশপল্লী। সেখানে তিনি নাটক ও সিনেমার শুটিংয়ের পাশাপাশি নিজের অবকাশ যাপনের জন্য ব্যবহার করতেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপে তিনি গড়েছেন সমুদ্র বিলাস কুটির। সেখানেও তার জীবনের সুন্দর অবকাশ যাপনের কিছুটা সময় কাটাতেন বছরের শীত মওসুমে।  হুমায়ূন আহমেদরা তিন ভাই। এর মধ্যে এক ভাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনিও কথাশিল্পী, নাট্যকার ও সায়েন্স ফিকশন লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। অন্য ভাই আহসান হাবীব। কার্টুনিস্ট ও রম্য লেখক হিসেবেই পরিচিত। রম্য ম্যাগাজিন ‘উন্মাদে’র সম্পাদক।  হুমায়ূন আহমেদ লেখক শিবির পুরস্কার থেকে শুরু করে একুশে পদক পর্যন্ত জয় করেছেন। তিনি প্রথম বিয়ে করেন গুলতেকিনকে। তবে সেই বিয়ে টেকেনি। হুমায়ূনের শেষ জীবনেসঙ্গী ছিলেন শাওন ও তার সন্তান নিষাদ ও নিনিত। গুলতেকিনের আছেন তিন কন্যাÑ নোভা, শীলা ও বিপাশা এবং এক ছেলে নূহাশকে নিয়ে। তাদের ঘিরেই কাটছে তার জীবন।  তার নির্মিত সর্বশেষ সিনেমা ঘেটুপুত্র কমলা মুক্তি পেয়েছে গত বছর। ২০১৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার লেখা শেষ উপন্যাস ‘দেয়াল’ প্রকাশিত হয়।

No comments:

Post a Comment