বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন: আলোচিত ব্যবসায়ী গিরিধারী লাল মোদির প্রতিষ্ঠান উত্তরা ট্রেডার্সকে ব্যবহার করে বেক্সিমকো গ্রুপের এক প্রতিষ্ঠান তুলে নিয়েছে ৮৮ কোটি টাকা বেসরকারি এবি ব্যাংক থেকে বেনামে ৮৮ কোটি টাকারও বেশি অর্থ তুলে নিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। এই বেনামি ঋণ নিতে বেক্সিমকো গ্রুপ আলোচিত হুন্ডি কারবারি গিরিধারী লাল মোদির প্রতিষ্ঠান উত্তরা ট্রেডার্সকে ব্যবহার করেছে। এবি ব্যাংক যা
চাই না করেই দ্রুত ঋণ দিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামে ঋণ নেওয়ার এই তথ্য উদ্ঘাটন করেছে। এবি ব্যাংক পরিচালক সূত্রে পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বেনামে ঋণ নেওয়ার বিস্তারিত প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ১ জুলাই উত্তরা ট্রেডার্স এবি ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখায় ৭০ কোটি টাকার ঋণ (সিসি বা ক্যাশ ক্রেডিট) চেয়ে আবেদন করে। এর পরের দিনই উত্তরা ট্রেডার্স একই শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলে। এর ১০ দিনের মাথায়, ১১ জুলাই শাখা ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে পাঠালে ২৫ জুলাই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ৫৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে। ২৯ জুলাই ঋণ মঞ্জুরের তথ্য শাখাকে জানানো হলে শাখা ৩১ জুলাই ও ৫ আগস্ট ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা করে উত্তরা ট্রেডার্সের চলতি হিসাবে পাঠিয়ে দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রথম দফায় ৩১ জুলাই উত্তরা ট্রেডার্সের হিসাবে ঋণের ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা জমা হওয়ার পর ওই দিনই দুটি চেক (১৭ ও ১০ কোটি) তৈরি করা হয় বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের নামে। ১৭ কোটি টাকার চেকটি এবি ব্যাংক প্রিন্সিপাল শাখার মাধ্যমে কারওয়ান বাজার শাখায় নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে জমা হয়। আর ১০ কোটি টাকার চেকটি আইএফআইসি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে জমা করা হয়। এভাবে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটি পুরো অর্থ নিয়ে নেয়। উত্তরা ট্রেডার্সের হিসাবে ঋণের অবশিষ্ট মাত্র ৫০ লাখ টাকা থেকে যায়। এই ৫০ লাখ টাকা এবং ৫ আগস্ট ঋণের আরও যে ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা উত্তরা ট্রেডার্সের হিসাবে জমা হয়, তা একত্রে (অর্থাৎ ২৮ কোটি টাকা) ৫ ও ৬ আগস্ট তৈরি পাঁচটি চেকে এবি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার মাধ্যমে একইভাবে কারওয়ান বাজার শাখায় নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে স্থানান্তর হয়। পুরো অর্থই প্রিন্সিপাল শাখায় নগদে উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি টাকার একটি চেক নগদে উত্তোলন দেখিয়ে তা ইনডিপেনডেন্ট পাবলিকেশনসের (বেক্সিমকো গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান) হিসাবে জমা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরপর স্থানীয় ব্যবসা বাড়াতে উত্তরা ট্রেডার্সের নামে ২৫ আগস্ট আরও ২৫ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করা হয়। ২৭ আগস্ট এবি ব্যাংকের পর্ষদ তা অনুমোদন করে। ২৯ আগস্ট প্রধান কার্যালয় ঋণ মঞ্জুরের তথ্য শাখাকে পাঠায়। ২ সেপ্টেম্বর উত্তরার হিসাবে তা জমা হলে পর্যায়ক্রমে ২, ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর তিনটি চেকের মাধ্যমে ২৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা কারওয়ান বাজার শাখায় নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে জমা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের অর্থ জমা ও স্থানান্তর ছাড়া উত্তরা ট্রেডার্সের চলতি হিসাবটিতে আর তেমন কোনো লেনদেন হয়নি। আর উত্তরা ট্রেডার্স যেদিন (২ জুলাই ২০১৩) এবি ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখায় চলতি হিসাব খোলে, একই দিন নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের নামে কারওয়ান বাজার শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। ঋণের সব অর্থ উত্তোলনের পর ২০১৩ সালে ৩ অক্টোবর নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের এ হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। উত্তরা ট্রেডার্সের হিসাব থেকে অর্থ স্থানান্তর ছাড়া নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের এ হিসাবে আর তেমন কোনো লেনদেনই হয়নি। এ ঋণের বিপরীতে সহায়ক জামানত হিসেবে যে সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা হয়েছে, তার আমমোক্তারনামা উত্তরা ট্রেডার্সের অন্যতম মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিরিধারী লাল মোদি হলেও সম্পত্তির মূল মালিকানা বেক্সিমকো গ্রুপের। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, উক্ত ঋণটি একটি বেনামি ঋণ, যার প্রকৃত বেনিফিশিয়ারি নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রি লি. (বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান)।’ যোগাযোগ করা হলে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এটা কোনো বেনামি ঋণ না। তিনি এই কথাটা বাংলাদেশ ব্যাংককেও বলেছেন। তিনি আরও বলেন, বেনামি ঋণ হয় ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু উত্তরা ও বেক্সিমকো উভয় বড় প্রতিষ্ঠান। ফলে এটা বেনামি ঋণ তৈরির জন্য নয়। তিনি দাবি করেন, ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে তাদের সঙ্গে উত্তরা ট্রেডার্স অর্থাৎ গিরিধারী লাল মোদিদের ব্যবসায়িক লেনদেন রয়েছে। পাটের ব্যবসা দিয়ে তাঁদের মধ্যে লেনদেন তৈরি হয়। ঋণের জামানত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকায় আমি তো এটা তাদের দিতে পারি।’ তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ‘বেনামি ঋণের অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের জন্যই হিসাবটি খোলা হয়েছিল এবং ঋণের প্রকৃত বেনিফিশিয়ারিকে (বেক্সিমকো গ্রুপ) আড়াল করার জন্যই অপ্রয়োজনীয়ভাবে বারবার প্রিন্সিপাল শাখাকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং অবশেষে সব অর্থই প্রিন্সিপাল শাখার মাধ্যমে নগদে উত্তোলন করা হয়েছে।’ এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম এ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে তাঁরা দুবার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনিও সালমান এফ রহমানের মতোই বলেন, এটা বেনামি ঋণ নয়। তাঁরা ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিয়েছেন। জমি বেক্সিমকোর, কিন্তু আপনারা উত্তরা ট্রেডার্সের ঋণের সহায়ক জামানত হিসাবে তা নিয়েছেন, আবার দুটি হিসাবই এক দিনে খোলা হয়েছে। হিসাব দুটিতে আর তেমন লেনদেন নেই—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, উত্তরা ট্রেডার্সের মালিক তাঁদের অনেক দিনের গ্রাহক। তাঁদের আরও হিসাব আছে। আর জমির আমমোক্তারনামা উত্তরা ট্রেডার্সের রয়েছে। ফলে তাঁরা সহায়ক জামানত হিসাবে তা নিয়েছেন। সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের পরিদর্শনে কিছু তথ্য বের হয়ে আসায় তাঁরা এবি ব্যাংককে ব্যাখ্যা তলব করেছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে তিন ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের ৩৩০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) অপসারণ করেছিল। বহুল আলোচিত সেই তিন ব্যবসায়ীর অন্যতম ছিলেন গিরিধারী লাল মোদি। বাকি দুই ব্যবসায়ী ছিলেন ওম প্রকাশ আগারওয়াল ও অশোক কেজরিওয়াল। ঋণ অনিয়মের জন্য আবার নাম এল গিরিধারী লাল মোদির।
No comments:
Post a Comment