বিনিয়োগ-সম্ভাবনার শীর্ষে থাকা চট্টগ্রামে যোগাযোগ সমস্যাই শিল্পায়নের প্রধান বাধা। সমস্যাটি চিহ্নিত হলেও তা সমাধানের লক্
ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ আটকে আছে রাজনৈতিক আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামকে স্বীকৃতি দিলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। শিল্প খাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দরটির ক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ কাজে লাগানো হচ্ছে। সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতারও ৪০ শতাংশ কাজে লাগানো হচ্ছে না। পর্যটন-সম্ভাবনাও কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেই। এভাবে চট্টগ্রামের সক্ষমতাকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে অক্ষমতা দিয়ে। অথচ অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রামের সক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে বিদ্যমান বাধাগুলো দূর করে দ্রুত অবকাঠামোগত দৃশ্যমান উন্নয়ন করতে হবে। আর চট্টগ্রামের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতি। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই) ও কালের কণ্ঠের যৌথ আয়োজনে গতকাল বুধবার ‘বিনিয়োগের প্রথম পছন্দ চট্টগ্রাম-সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সক্ষমতা কতদূর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এভাবে সমস্যা চিহ্নিত করে উত্তরণের পথ বাতলে দিয়েছেন। বৈঠকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, ভারতের একজন কূটনীতিক ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আলোচনায় অংশ নেন। কালের কণ্ঠ সম্পাদক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন। চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলমের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, এটা প্রমাণিত যে সমুদ্রবন্দরসহ প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে যেকোনো বিনিয়োগ দেশের অন্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক। চট্টগ্রামে এক টাকা বিনিয়োগ করে ১০০ টাকা লাভ তুলে আনা সম্ভব। এ কারণেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রথম পছন্দ চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম হচ্ছে দেশের বাতিঘর, তাই চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ : বৈঠকে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম হচ্ছে দেশের গেটওয়ে। তাই চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের নৌ, সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ সহজ ও দ্রুততর করলে এবং নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎসেবা দিতে পারলে বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রামে বিনিয়োগ করবেন। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো, চট্টগ্রামে দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা দ্রুত বাস্তবায়ন, পর্যটনশিল্পের অপার-সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারি পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন চান। সক্ষমতাকে অক্ষম করে রাখা হয়েছে : কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ মানুষ তৈরি না হলে রাষ্ট্র তৈরি হবে না। চট্টগ্রাম হচ্ছে দেশের বাতিঘর। চট্টগ্রামের সম্ভাবনাময় মানুষগুলোর প্রচুর সক্ষমতা রয়েছে; কিন্তু এদের অক্ষম করে রাখা হয়েছে। শুধু চট্টগ্রাম নগরীকে ব্যবহার করেই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব। এ জন্য গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।’ কালের কণ্ঠ সব সময় পাশে থাকবে : চট্টগ্রাম-ঢাকা পথে যাতায়াতে এখনো প্রচুর সময় নষ্ট হয় বলে উল্লেখ করেন কালের কণ্ঠ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ শেষ করতে হবে। পাহাড়-সমুদ্রবেষ্টিত চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগালে দেশেরই উন্নয়ন ঘটবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের পাশাপাশি পর্যটন-সম্ভাবনারও সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। চট্টগ্রামবাসীর এই উন্নয়ন সংগ্রামে কালের কণ্ঠ সব সময় পাশে থাকবে।’ গোলমেলে উন্নয়ন হচ্ছে : ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দার খান বলেন, ‘চট্টগ্রামে এখন গোলমেলে উন্নয়ন হচ্ছে। চট্টগ্রামে এমন কিছু উন্নয়ন হচ্ছে যাতে জনদুর্দশা বাড়বে। এর জন্য সেবা খাতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বন্দর, ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন দায়ী। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। তারা উন্নয়নের চেয়েও ঢাকায় গিয়ে দেনদরবারে সময় ব্যয় করে। কিন্তু এটা তাদের কাজ না।’ চট্টগ্রামের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি। এক টাকা বিনিয়োগে ১০০ টাকা তুলে আনা সম্ভব : চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সাবেক সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেন, ‘চট্টগ্রাম এমন সম্ভাবনাময় জায়গা যেখানে এক টাকা বিনিয়োগ করে ১০০ টাকা তুলে আনা সম্ভব। অথচ চট্টগ্রাম-ঢাকা হাইওয়ে নির্মাণআজও সম্পন্ন হয়নি। এই সড়কে নতুন একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, লাকসাম-ঢাকা কর্ড রেললাইন ও রেলের ডাবল লাইন দ্রুত নির্মাণের মাধ্যমে কানেকটিভিটি বাড়ানো এবং কর্ণফুলীর দুই পাশকে বিনিয়োগের জন্য কাজে লাগানো উচিত।’ তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। দরকার শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা। যোগাযোগ সহজ হলে বিনিয়োগ বাড়বে : সাবেক সংসদ সদস্য মাজহারুল হক শাহ বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। অথচ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি (ঢাকা-চট্টগ্রাম) নির্মাণ শেষ হয়নি। যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে : বিজিএমইএ-এর অঞ্জন শেখর রায় বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য মূলত পোশাকশিল্পনির্ভর। এর বিকাশ শুরু চট্টগ্রাম থেকেই। আশির দশকে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে দেশ গার্মেন্টের মাধ্যমে এ দেশের পোশাকশিল্পের যাত্রা শুরু। ১৯৮৪ সালে দেশের প্রথম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল চট্টগ্রাম ইপিজেড প্রতিষ্ঠা করা হয়। অথচ সেই চট্টগ্রামই এখন ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। আগে মোট পোশাক রপ্তানির ৪০ শতাংশ চট্টগ্রাম থেকে হতো, এখন তা ২০ শতাংশের নিচে নেমেছে। চট্টগ্রাম চেম্বারের সহসভাপতি সৈয়দ জামাল আহমেদ বলেন, কোরিয়ান ইপিজেডে প্রচুর অব্যবহৃত প্লট রয়েছে। এগুলো দেশীয় ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান তিনি। বনফুল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম চেম্বার পরিচালক এম এ মোতালেব বলেন, চেম্বারের অর্থায়নে নির্মিতব্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সক্ষমতা আরো একধাপ বাড়ল। এই সেন্টারের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সব তথ্য মিলবে। বারভিডা সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক চৌধুরী বাবর বলেন, চট্টগ্রামে অগ্রগতি কম হয়নি তবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়েছে কি না তাই বড় প্রশ্ন। নীতিনির্ধারকরা আন্তরিক হলে চট্টগ্রামে কাঙ্ক্ষিত অর্জন সম্ভব। চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী ফজলুল্লাহ ওয়াসার বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্য দিয়ে বলেন, ২০২১ সালে চট্টগ্রামে পানির কোনো সংকট থাকবে না। ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নগরবাসী দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা পানি পাবে। এখন চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের জন্য একটি স্যুয়ারেজ লাইন নির্মাণে জাইকা ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কাজ চলছে। চট্টগ্রাম চেম্বার পরিচালক মাহফুজুল হক শাহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আরো আলোচনা করেন বিকেএমইএর নেতা শওকত ওসমান, চট্টগ্রাম চেম্বার পরিচালক ও রাইজিং গ্রুপের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন চৌধুরী, রিহ্যাব চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার এস এম আবু সুফিয়ান, ট্রেডবডি নেতা তাহের সোবহান, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি মেম্বার মোসলেহ উদ্দিন খালেদ, চট্টগ্রাম আনসার ও ভিডিপির উপপরিচালক এ এস এম আজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ছালামত আলী প্রমুখ।
No comments:
Post a Comment