আবুল কাশেম যখন সরকারের যুগ্ম সচিব ছিলেন তখন তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন এপিডির। এই পদ হলো মহাক্ষমতাধর একটি পদ। বাংলাদেশের
প্রশাসন যাঁরা চালান সেই সচিব, অতিরিক্ত সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নিয়োগ-বদলি হতো তাঁর হাতে। সরকারের পক্ষে তিনিই দিতেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। প্রেষণসহ প্রভাবশালীদের পদোন্নতির চূড়ান্ত আদেশেও থাকত তাঁর স্বাক্ষর। তাই সবাই তাঁকে তোয়াজ করে চলত। মনমতো একজন ডিসি পাওয়ার জন্য এমপিরা তাঁর পেছনে ঘুরতেন। মন্ত্রীরা একজন দক্ষ কর্মকর্তার জন্য তাঁর কাছেই তদবির করতেন। এপিডি (নিয়োগ, পদায়ন ও প্রেষণ) থেকে বদলি হয়ে পরিবহন পুলের কমিশনার হওয়ার পরও পদের জৌলুসের ঘাটতি ছিল না তাঁর। তখন তিনি অতিরিক্ত সচিব। কিন্তু গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায়ের পর সব ওলটপালট হয়ে যায়। ক্ষমতাধর সেই কর্মকর্তা ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হয়ে যান। চাকরির ‘মধু’ খাওয়ার জন্য তাঁর চারপাশে যাঁরা ঘুরঘুর করতেন তাঁরা আর তাঁকে চেনেনই না। চাকরি আছে, কাজ নেই। ঠিকানা আছে, বসার জায়গা নেই। বন্ধুবান্ধবের রুমে আড্ডা দিয়ে সময় কাটে তাঁর। একসময় তাঁরাও বিরক্ত হন। ওএসডি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ায় বিব্রত হয় পরিবারের সদস্যরাও। কাঁটায় কাঁটায় চার বছর এই দুঃসহ ওএসডি-জীবনের পর গত ৩১ ডিসেম্বর স্বাভাবিক নিয়মে অবসরে যান আবুল কাশেম। আবুল কাশেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা আমার দ্বারা উপকৃত হয়েছে তারাই বেইমানিটা বেশি করেছে। তাই আমি সব কিছু ভুলে যেতে চাই। চাকরিজীবন নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছা করে না।’ রাজনৈতিক রেষারেষির শিকার এসব সরকারি কর্মকর্তার ওএসডির মধ্যেই কর্মজীবনের অবসান ঘটে চলেছে। দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকার পর বিদায়বেলায় তাঁদের ভাগ্যে জোটে না একটি ফুল বা কোনো সমবেদনার বাণী। মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে তাঁরা হাঁটছেন মৃত্যুর পথে। কারণ বহু বছরের পরীক্ষিত পদ্ধতি ‘অবসর’ তখনই দেওয়া হয় যখন কর্মক্ষমতা থাকে না। আর কর্মক্ষমতা থাকার সময় তাঁদের ওএসডি বানিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। দেশের মানুষ তাঁদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর এভাবে ‘সাধারণ মানুষকে সেবাবঞ্চিত করতে’ সরকারের ব্যয় হয়েছে ৫০ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। এই ব্যয় হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এবারের টানা দুই সরকারের আমলে মোট ১৬৩ জন ওএসডির পিছে। টাকার পাশাপাশি অপচয় হয়েছে বিপুল কর্মশক্তিরও। গত মহাজোট সরকারের আমলে দীর্ঘ সময় ওএসডি থাকার পর গত ১০ মাসে ১০ জন অতিরিক্ত সচিব অবসরে গেছেন। দীর্ঘ কর্মহীনতার পর আরো অবসরে যাচ্ছেন তিন সচিব, ২৫ অতিরিক্ত সচিব, ৮৫ যুগ্ম সচিব। তাঁরাও কর্মহীন গত মহাজোট সরকারের প্রায় শুরু থেকেই। ওএসডি কর্মকর্তাদের কাজে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমান নাম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) সাবেক সচিব ড. মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব ভালো আলামত নয়। কারণ ছাড়াই কাউকে দীর্ঘদিন ওএসডি করে রাখা এবং সেখান থেকেই বিদায় দেওয়া অসুস্থ সার্ভিসের লক্ষণ। কোনো কর্মকর্তা অপরাধ করে থাকলে বিধিবিধান অনুযায়ী তাঁর বিচার হবে। কিন্তু শাস্তিও দেবেন না, আবার ঝুলিয়েও রাখবেন- বিষয়টা অসহনীয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার জন্য এ ধরনের বিদায় অসম্মানের, গ্লানির। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, পুরো প্রশাসন মানহীন অবস্থায় পৌঁছে গেছে।’ সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অধিকার বজায় রাখা সরকারের দায়িত্ব। রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি করা হলে দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন প্রত্যাশা করা যায় না। অতিরিক্ত সচিব পদে দীর্ঘ সময় ওএসডি থাকার পর যাঁরা গত ১০ মাসে অবসরে গেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম মফিজুল করীম। তিনি ওএসডি হয়েছিলেন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র ১৮ দিনের মাথায়। মহাজোট শপথ নিয়েছিল ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি। তাঁকে ওএসডি করা হয় ২৭ জানুয়ারি। মফিজুল করীম গত ২৬ এপ্রিল অবসরে যান। গত ৩১ ডিসেম্বর অবসরে গেছেন আবুল কাশেম। তিনি ওএসডি হয়েছিলন ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ২০১০ সালে ওএসডি হয়েছিলেন মাহবুবুল আলম। গত ১৬ জানুয়ারি তিনি অবসরে গেছেন। খন্দকার মোহাম্মদ আলী অবসরে গেছেন গত ২৩ সেপ্টেম্বর। তিনি ২০১২ সাল থেকে ওএসডি হয়েছিলেন। এ সময় আরো যাঁরা অবসরে গেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন খুরশিদা খাতুন, এ কে এম ইয়াহিয়া, ড. হাফিজুর রহমান, সৈয়দ মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। একজন অতিরিক্ত সচিবের বেতন স্কেল ৩৩ হাজার থেকে ৩৯ হাজার টাকা। এই পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার পেছনে সরকারের মাসে ব্যয় হয় গড়ে প্রায় এক লাখ তিন হাজার টাকা। ২০০৯ সাল থেকে ১০ জন অতিরিক্ত সচিব ওএসডি হয়ে আছেন। এর মধ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকেই ওএসডি তিনজন। ওই বছর থেকে যাঁরা ওএসডি হয়ে আছেন তাঁরা হলেন মাসুদ এলাহী, মামুনুর রশিদ চৌধুরী, উইলিয়াম অতুল কুলুন্তুনু, আফতাব হোসেন, মাকসুমুল হাকিম চৌধুরী, ফজলুর রহমান, মোকলেসুর রহমান, মাহমুদুল করীম, ড. এস কে আব্দুর রশিদ ও আবু বকর মো. শাজাহান। ড. এস কে আব্দুর রশিদ তাঁর ব্যাচে মেধাতালিকায় প্রথম হয়েছিলেন। তিনি ওএসডি হয়ে আছেন ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে। সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। ২০০৯ সাল থেকে ১০ জন ছাড়াও অতিরিক্ত সচিব পদে ২০১০ সাল থেকে ওএসডি হয়ে আছেন চারজন, ২০১২ সাল থেকে একজন এবং ২০১৩ সাল থেকে দুজন। এসব কর্মকর্তার পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯ কোটি ৬৬ লাখ ১৪ হাজার টাকা। চাকরির শেষ পর্যায়ে পৌঁছানো একজন যুগ্ম সচিবের পেছনে সরকারের মাসে গড়ে প্রায় ৯৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়। ২০০৯ সাল থেকে ওএসডি হয়ে আছেন ২৩ জন। তাঁদের মধ্যে ওই বছরের জানুয়ারিতেই ওএসডি হয়েছেন ড. এ এইচ এম মুস্তাইন বিল্লাহ। একই বছরের ৯ জানুয়ারি শপথ নেওয়ার পর নতুন সরকার তাঁকে ২০ জানুয়ারি ওএসডি করে। একই দিনে ওএসডি হয়েছেন আনিস উদ্দিন মঞ্জুর। এর তিন দিন পর ওএসডি করা হয় মো. দেলোয়ার হোসাইনকে। পরের মাস ফেব্রুয়ারি থেকে যুগ্ম সচিব রোকসানা ফেরদৌসী, সিরাজউদ্দিন মিয়া, জামালউদ্দিন আহমেদ, আখতার আহমেদ এখনো ওএসডি হয়ে আছেন। একই বছরের মার্চ থেকে ওএসডি হওয়া এ বি এম আবদুস সাত্তার, আহমেদ হোসাইন, ড. মো. আবদুল হামিদ, এফ এম আবদুল মুনেম ৬৮ মাস পরও কাজে ফিরতে পারেননি। ২০০৯ সাল থেকে ২৩ জন, ২০১০ থেকে ১২ জন, ২০১১ থেকে ১৩ জন, ২০১২ থেকে আটজন ও ২০১৩ থেকে ২৯ জন যুগ্ম সচিব ওএসডি হয়ে আছেন। নানা ধাপে ওএসডি হওয়া এসব কর্মকর্তার পেছনে চলতি মাস পর্যন্ত সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি ৪১ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। উপসচিব পদে কর্মরতরা ২২ হাজার ২৫০ থেকে ৩১ হাজার ২৫০ টাকা স্কেলে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। একজন উপসচিব গড়ে মাসে ৪২ হাজার টাকা পান। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ওএসডির কবলে পড়া দুই উপসচিব বসিরউদ্দিন আহমেদ ও আবদুল্লাহ আল বাকীকে এখনো কাজে ফিরতে দেওয়া হয়নি। একই বছরের মে থেকে মোহাম্মদ শমসের আলী, জুন থেকে এস কে আলাউদ্দিন, আগস্ট থেকে এমদাদুল হক ও শাহানা ইয়াসমিন, সেপ্টেম্বর থেকে খন্দকার মো. মোখলেসুর রহমান এবং ডিসেম্বর থেকে নাজিমউদ্দিন চৌধুরী ওএসডি হয়ে আছেন। এ ছাড়া ২০১০ সাল থেকে তিনজন, ২০১১ থেকে ৯ জন, ২০১২ থেকে ১৫ জন ও ২০১৩ থেকে ১৪ জন উপসচিব ওএসডি হয়ে আছেন। এসব কর্মকর্তার পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে সাত কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে তিনজন সচিব ওএসডি হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে ইবাদত আলী ৩৭ মাস, মাহবুবুর রহমান ১৯ মাস এবং নুরুল হক ওএসডি হয়ে আছেন ১৫ মাস ধরে। এসব সচিবের পেছনে প্রতি মাসে সরকারের গড়ে ব্যয় হয় এক লাখ ১০ হাজার টাকা। বসিয়ে রেখে এসব সচিবের পেছনে সরকার এ পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৭৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। সবচেয়ে পুরনো ওএসডি : ২০০৭ সালের ২৬ মার্চ থেকে যুগ্ম সচিব রফিকুল আই মোহামেদ ওএসডি হয়ে আছেন। একই বছরের ৩১ মার্চ থেকে যুগ্ম সচিব এ কে এম জাহাঙ্গীর কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন। ২০০৭ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে উপসচিব কামরুজ্জামান চৌধুরী ওএসডি হয়ে আছেন। ২০০৮ সালের ১৩ মে থেকে ওএসডি হয়ে আছেন যুগ্ম সচিব সি এম ইউসুফ হোসাইন। ২০০৮ সালের ১৪ জুন থেকে ওএসডি হয়ে আছেন উপসচিব রুহুল আমীন। অতিরিক্ত সচিবদের মধ্যে শফিকুল ইসলাম ওএসডি হয়ে আছেন ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে। অ্যাটাচমেন্ট : প্রশাসনের আরেক যন্ত্রণার নাম ওএসডি অ্যাটাচমেন্ট বা সংযুক্তি। কর্মকর্তাদের ওএসডি করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে সংযুক্ত করে রাখা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জনপ্রশাসনে ওএসডি হলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কিছু নির্ধারিত কাজ করতে পারেন। তবে তাঁকে যে মন্ত্রণালয়ে অ্যাটাচমেন্ট দেওয়া হয় সেই মন্ত্রণালয় থেকে তাঁকে বেতন-ভাতা দেওয়া হয় না। তাঁর বেতন-ভাতা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে। অনেক কর্মকর্তা ওএসডির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অ্যাটাচমেন্ট পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এতে তাঁদের অন্ততপক্ষে বসার জায়গাটুকু নিশ্চিত হয়। বর্তমানে ১৩১ জন যুগ্ম সচিব ওএসডি হয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে সংযুক্ত হয়ে আছেন। ১২ জন উপসচিবও সংযুক্তিতে রয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষা ছুটি, প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে থাকায় কিছু কর্মকর্তা ওএসডি হয়ে আছেন। তবে তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। এ ছাড়া দুর্নীতি, শৃঙ্খলাজনিত ও অসদাচরণের জন্য কিছু কর্মকর্তা ওএসডি আছেন। এসব কারণে ২০১৪ সালেও কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment