Sunday, November 23, 2014

বংশপরম্পরার ঠকবাজির 'ডলার ব্যবসা'!:কালের কন্ঠ

ঠকবাজি ওদের ‘পেশা’। ঠকছে লোভী প্রকৃতির মানুষ। সস্তায় ডলার পাওয়ার লোভে হারাচ্ছে বিপুল অঙ্কের টাকা। ওদের প্রতারণার ফাঁদ
দেশের সর্বত্র। দিনমজুর, ঠেলাগাড়ি-ভ্যানচালক, রিকশাচালক বা গৃহপরিচারিকার বেশে ওরা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। বংশপরম্পরায় চলছে এ ভয়ংকর প্রতারণা ‘ব্যবসা’। কিশোরগঞ্জের ২০-২৫টি গ্রামের শতাধিক ডলার প্রতারক এসব করেই এখন কোটিপতি। র‌্যাব ও পুলিশের অভিযান চললেও বন্ধ হচ্ছে না প্রতারণা। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থানায় ডলার প্রতারণার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। জনগণকে সচেতন করতে প্রশাসন অবশ্য কিশোরগঞ্জ সদর ও কটিয়াদীর বিভিন্ন স্থানে ‘ডলার প্রতারক হইতে সাবধান’ জাতীয় বাণী লিখে স্থায়ী সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে। বাণী সাইনবোর্ডের মতোই স্থবির হয়ে পড়ে রয়েছে। কটিয়াদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেদায়েতুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রতারকদের নামে আলাদা ফাইল ও রেজিস্ট্রার বই খোলা আছে। ফাইলটি এখন গোয়েন্দা পুলিশের জিম্মায়। ওসির ভাষ্য, ‘এমন মজার ব্যবসা পৃথিবীতে আর নাই। প্রতারণা ওদের রক্তে। আবার প্রতারিতরাও বেশির ভাগ সময় থানায় আসে না।’ তিনি বলেন, ‘প্রতারকরা একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রশ্রয় পায়। তাই এদের নির্মূল করা কঠিন।’   সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর কটিয়াদী পৌরসভার কাহেতেরটেকির হাবিবুর রহমানের বাড়ি থেকে ১০০ ইউএস ডলারের ৯২টি জাল নোটসহ বরিশালের বাকেরগঞ্জের প্রতারক নাসির সরদার ও লক্ষ্মীপুরের ঘিলাবাইতের বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২৬ অক্টোবর প্রতারণার শিকার হন নিকলী সদর, দামপাড়া ও মজলিশপুরের চার ব্যক্তি। এদের মধ্যে সরকারি কর্মচারীও রয়েছেন। প্রতারিতদের একজন মতি মিয়া জানান, ঢাকা থেকে নিকলিতে তাঁর বাড়ি ফেরার পথে বাসে এক নারীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ওই নারী তাঁর নাম আশা ও বাড়ি কটিয়াদীর করগাঁও বলে জানান। কথার ফাঁকে জানান, সিলেটে কাজ করতে গিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া অনেকগুলো ডলার তিনি বিক্রি করবেন। ২৪৯টি ‘বড় নোট’ ও ৫০টি ‘ছোট নোট’ দামদর করে আড়াই লাখ টাকায় রফা হয়। মতি মিয়া জানান, তাঁর ভায়রা ভাই নিকলীর নৌপরিবহন শ্রমিক মুখলেছ আড়াই লাখ টাকা নিয়ে ঘটনার দিন নওবাড়িয়ার শান্তুর ঘরে যান। প্রতারকরা টাকা বুঝে নিয়ে ৮৩টি ডলারের মতো দেখতে কাগজ মুখলেছের হাতে গুঁজে দেয়। এর পরই কয়েকজন এসে তাদের ধাওয়া করলে তারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচান। মুখলেছ জানান, ঘটনার পর আশাকে ফোন করলে তিনি (আশা) নিজের নাম মরিয়ম ও বাড়ি রায়খলা বলে ফোন কেটে দেন। এমন ঘটনা শত শত। তবে বুদ্ধি খাটিয়ে প্রতারণার জাল কেটে বেরিয়ে আসার কথাও জানা যায়। গত এপ্রিলের ঘটনা। তাড়াইলের কাজলা মধ্যপাড়ার রোকনউদ্দিনকে কটিয়াদীর সতরদ্রোনের প্রতারক মতিউর রহমান ও করিমগঞ্জের নিয়ামতপুরের আওয়াল জানায়, তাদের কাছে ডলার আছে, সস্তায় বিক্রি করবে। দরদাম করে রোকন ৩০ হাজার টাকায় ৩০টি ১০০ ‘ডলারের’ নোট  কেনেন। ডলারগুলো জাল বলে সন্দেহ হলে তিনি কৌশলে গচিহাটা ফাঁড়ির পুলিশকে ঘটনাটি জানান। পরে পুলিশ এসে ১০৯টি জাল ডলারসহ মতিউর ও আওয়ালকে গ্রেপ্তার করে। কটিয়াদীর নওবাড়িয়ার কাদির জাল ডলার ও সোনার পুতুল প্রতারণার ‘ব্যবসা’ করে এখন ‘বড়লোক’। আগে হাটের দিনে তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুরগি কিনে খাঁচায় ফেরি করে বেচতেন। সাত-আট বছরে ‘ভাগ্য’ ফিরেছে। এখন ২০-২২ লাখ টাকার দালানঘরে থাকেন। রাস্তার পাশে দোকান করে ভাড়া দিয়েছেন। অবশ্য পুলিশের হাতে কাদির বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। কটিয়াদী থানায় কাদিরের সংরক্ষিত ছবিতে লেখা রয়েছে, ‘ডলার ও সোনার পুতুল প্রতারক কাদির’। এলাকাবাসী কাদির সম্পর্কে নানা তথ্য দিলেও নাম প্রকাশে কেউ রাজি হয়নি। প্রতারণার শিকার ব্যক্তি ও প্রতারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকাসহ সারা দেশেই এরা সক্রিয়। দিনমজুর বা গৃহপরিচারিকার বেশে ওরা থাকে। অনেকে রিকশা, ঠেলাগাড়ি ও ভ্যান চালায়। সুযোগ বুঝে ওরা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে ডলারের বার্তা পৌঁছায়। ওরা গল্প ফাঁদে, ‘বাসায় কাজ করতে গিয়ে এক মহিলা ডলার চুরি করে এনেছে।’ অথবা বলে, ‘মাটি কাটতে গিয়ে এক কামলা সোনার পুতুল পেয়েছে।’ এভাবে নানা গল্প বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করে তারা। বলে, ‘অল্প টাকা হলেই বেচে দেবে।’ লোভী প্রকৃতির লোকজন খুব সহজেই প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে যায়। এলাকাবাসী জানায়, ডলারের ‘বার্তাবাহক’ হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কর্মীর সংখ্যা সহস্রাধিক। এরা ‘মক্কেল’ জোটাতে পারলে মোটা অঙ্কের বখরা পায়। ২৬ অক্টোবরের প্রতারণার ঘটনায় জড়িত ‘আশা’ বা ‘মরিয়ম’ও এদের একজন। নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক ডলার প্রতারক জানায়, একটি ‘কাজে’র জন্য প্রতারক দলের কর্মীরা মাসের পর মাস অপেক্ষা করে। তার ভাষ্য, বংশপরম্পরায় চলছে এ ‘ব্যবসা’। বাবার পথ ধরে ছেলেও নামছে এ পথে। সরেজমিন অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে, কটিয়াদীর পূর্বাঞ্চলে যে কয়েকটি গ্রামে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়, নওবাড়িয়া এর মধ্যে অন্যতম। এ গ্রামের দরিদ্র রিকশাচালক শান্তু পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে থাকেন। সবচেয়ে বেশি ‘ডলার’ কেনাবেচার নাটক সাজানো হয় শান্তুর পরিত্যক্ত ঘরেই। গ্রামবাসী জানায়, নিরীহ শান্তু প্রতারকদের ভয়ে বাড়ি আসেন না। মতিন নামে প্রতারণার শিকার নিকলীর এক ব্যক্তি জানান, প্রথমবার প্রতারকরা তাঁদের আসল ডলার দেখায়। ডলার পরখ করে সন্তুষ্ট হয়েই দ্বিতীয়বার টাকা-পয়সা নিয়ে তাঁরা ডলার নিতে যান। পরে টাকা-পয়সা লেনদেনের সময় লোকজন এসে হাজির হয়। এদের কেউ পুলিশ সাজে। কেউ সাজে মেম্বার। কেউ আবার স্থানীয় চেয়ারম্যানের ছেলে পরিচয়ে ব্যাপারটা ‘ম্যানেজ’ করতে এগিয়ে আসে। প্রতারণার শিকাররা জানায়, চুক্তিমতো টাকা পরিশোধ করার সঙ্গে সঙ্গেই লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রতারকচক্রের অন্য সদস্যরা এসে হামলা চালায়। প্রাণ বাঁচাতে ডলার ফেলেই অনেকে ফিরে যায়। আবার কেউ কেউ ডলার নিয়ে দেখে, ওগুলো জাল। পুলিশের একশ্রেণির সদস্যের বিরুদ্ধেও প্রতারকদের সঙ্গে ‘খাতির-প্রণয়ের’ অভিযোগ রয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, গচিহাটা পুলিশ ফাঁড়িটি কিছুদিন আগে ছিল করগাঁও বাজারে। সে সময় প্রতারকচক্রের মূল হোতাদের প্রকাশ্যে ফাঁড়িতে আসা-যাওয়া করতে দেখা গেছে। প্রতারক কাদিরসহ কয়েকজন প্রতারককে পুলিশের মোটরসাইকেলেও চড়তে দেখেছে অনেকে। কটিয়াদী থানার ওসির ভাষ্য, ‘চোর ধরতে গেলে চোরদের সঙ্গে মিশতে হয়। চোর ধরতে পারলে পুলিশের সুনাম হয়, আর না হলে দুর্নাম।’ কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সৈয়দ আবু সায়েম জানান, তিনি কিশোরগঞ্জে আসার পর ডলার প্রতারণার ঘটনা শোনেননি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রতারণার ঘটনাটি অবহিত করলে প্রতারণার শিকারদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি জানান, এ ঘটনায় মামলা করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। তাঁর মতে, ডলার প্রতারকদের পাশাপাশি ক্রেতারাও সমান অপরাধী। ক্রেতারা আক্রান্ত হয়েও সহজে থানায় আসতে চায় না।

No comments:

Post a Comment