নাগরিকদের আবাসনের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে প্লট ও ফ্ল্যাট প্রকল্প বাস্তবায়
ন করছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (এনএইচএ) মাধ্যমে। কিন্তু এসব প্রকল্পের সুযোগে সংস্থাটি একের পর এক বিলাসবহুল গাড়ি কিনছে। আর এসব দামি গাড়ি কেনা হচ্ছে সাধারণ মানুষের জামানতের টাকায়। যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা পদাধিকার বলে সরকারি গাড়ির সুবিধা পান। এর বাইরে তাঁদের আর গাড়ি নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু এনএইচএর যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা প্রকল্প থেকে গাড়ি নিয়েছেন হরহামেশাই। আবার প্রতিটি গাড়ির জ্বালানিসহ পরিচালনা ব্যয় বাবদ সরকারের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ৪৫ হাজার টাকা করে। ২০০১ সালে গৃহসংস্থান অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ করার পর মূলত ব্যাপক প্রকল্প হাতে নেয় সংস্থাটি। জানা যায়, বর্তমানে তাদের ৪২টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। পাঁচ-ছয় বছর ধরে প্রায় প্রতিটি ফ্ল্যাট প্রকল্পের টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি কিনছে এনএইচএ। এ নিয়ে এনএইচএর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও রয়েছে ব্যাপক গুঞ্জন। তাঁদের দাবি, অযৌক্তিকভাবে এসব গাড়ি কেনার ফলে ফ্ল্যাটের দাম হচ্ছে আকাশচুম্বী। এ কারণে লোকজন লটারির মাধ্যমে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়ার পরও আগ্রহ হারিয়ে জামানতের টাকা তুলে ফেলছে। তবে বিশেষ দু-একটি প্রকল্পে কৌশলগত কারণে দামি গাড়ি না কেনায় ওই সব প্রকল্পের ফ্ল্যাটের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম পড়ছে। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের প্রকল্পসংক্রান্ত নথি থেকে দেখা যায়, রাজধানীর একই এলাকায় দুটি প্রকল্পে ফ্ল্যাটের দাম দুই রকম। যেখানে গাড়ি ও অন্যান্য চার্জ ধরা হয়নি সেখানে ফ্ল্যাটের দাম অনেক কম। আর যেখানে গাড়ি ও সার্ভিস চার্জ ধরা হয়েছে সেখানে বাজার মূল্যের চেয়েও দাম অনেক বেশি। সম্প্রতি কক্সবাজার ও রাজশাহী বিভাগের ফ্ল্যাট প্রকল্পে দুটি পাজেরো স্পোর্টস কার কেনা হয়েছে। একেকটি গাড়ির মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। এনএইচএর নথি থেকে আরো দেখা যায়, মিরপুর ১৬ নম্বর সেকশনে ‘আনন্দনগর আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ’ প্রকল্পে ২৮টি ১৪তলা ভবনে ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। এক হাজার ৩৮৫ বর্গফুটের প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য ৭৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। আর একই এলাকার ১৫ নম্বর সেকশনে ১০০ ফ্ল্যাট প্রকল্পে এক হাজার ৫০০ বর্গফুটের প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, আনন্দনগর ফ্ল্যাট প্রকল্পে এরই মধ্যে একটি বিলাসবহুল পাজেরো জিপ কেনা হয়েছে। আর সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহতদের ১৫ নম্বর সেকশনের ওই প্রকল্পে ফ্ল্যাট দেওয়া হবে বলে সেখানে গাড়ি কেনা হয়নি। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কৌশল অবলম্বন করেছেন। কারণ তাঁদের ভয়, এ প্রকল্পে ফ্ল্যাটের উচ্চমূল্য ধরা হলে তা সরকারপ্রধানের নজরে পড়ে যেতে পারে। একই অবস্থা দেখা যায় মিরপুর ‘জয়নগর’ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। সেখানে পাঁচটি ১৪ তলা ভবনে এক হাজার ৫০০ বর্গফুটের ৫২০টি ফ্ল্যাট নির্মাণকাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয়েছে ৭৩ লাখ টাকা। পরে নানা বিতর্কের কারণে করা হয়েছে ৬৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। ওই প্রকল্পেও একটি পাজেরো জিপ কেনা হয়েছে। আবার লালমাটিয়া হাউজিং এস্টেট সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ১৮২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে এক হাজার ২৫০ বর্গফুটের প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম ধরা হয়েছে ৬১ লাখ চার হাজার টাকা। ২০১২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার বটিয়া এলাকায় ‘মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ফ্ল্যাট’ নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান। দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে ডিসেম্বর ২০১৩ নির্ধারণ করা হয় প্রকল্পের মেয়াদ। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে অযৌক্তিকভাবে গ্রহণ করা ওই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। প্রকল্প আলোর মুখ না দেখলেও প্রকল্পের নামে দামি গাড়ি কেনা বাদ দেওয়া হয়নি। সরকারি কোষাগার থেকে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে একটি জিপ। মান্নান খান প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ওই জিপ ব্যবহার করেছেন তাঁর ভাই ও দলীয় কয়েকজন নেতা। বর্তমানে জিপটি ব্যবহার করছেন সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী। সম্প্রতি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের আওতাধীন কক্সবাজারের কলাতলীতে একটি ফ্ল্যাট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এরপর নিয়ম অনুযায়ী লটারির মাধ্যমে বিজয়ীদের নামও ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রকল্প স্থানে এখনো তেমন কোনো উন্নয়নমূলক কাজ হয়নি। কাজ না এগোলেও সাধারণ মানুষের জামানতের টাকা দিয়ে গাড়ি কিনতে ভোলেননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রায় কোটি টাকা দিয়ে একটি পাজেরো স্পোর্টস ব্র্যান্ডের গাড়ি কেনা হয়েছে। বর্তমানে এ গাড়িটি ব্যবহার করছেন জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান খন্দকার মো. আকতারুজ্জামান। আর চেয়ারম্যানের আগের গাড়িটি ব্যবহার করছেন একজন সদস্য। এ ছাড়া একই সময়ে রাজশাহী বিভাগের একটি ফ্ল্যাট প্রকল্পে প্রায় ৯৩ লাখ টাকা দিয়ে একটি বিলাসবহুল গাড়ি কেনে এনএইচএ। জানা যায়, গাড়িটি বর্তমানে ব্যবহার করছেন সংস্থার সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) মো. সানোয়ার আলী। এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সরকার যে উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাট প্রকল্প হাতে নেয় তা ভেস্তে যায় প্রকৌশলীদের উচ্চাভিলাষী চিন্তা-ভাবনার জন্য। তাঁরা প্রকল্প হাতে নিয়েই একটি বিলাসবহুল গাড়ি কেনেন। আর কারণে-অকারণে বিদেশ ভ্রমণ করেন। ফলে সাধারণ মানুষকে যে মূল্যে ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা তা সম্ভব হয় না। এ ধরনের কার্মকাণ্ডের ফলে এখন বেশি দামি সরকারি ফ্ল্যাট বিক্রয় হয় না বললেই চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফ্ল্যাট ব্যবসায়ীদের চেয়েও সরকারি ফ্ল্যাটের দাম বেশি পড়ে যায়। অথচ সরকারি জমির দাম ধরা হয় নামমাত্র, যা বাজারমূল্যের অনেক কম।’ ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি খাতে ফ্ল্যাটের দাম অনেক কম হওয়ার কথা। উন্নয়নকাজে যা খরচ হবে তা-ই নেবে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যে উচ্চমূল্য সরকারি প্রতিষ্ঠান আদায় করছে তা অন্যায় ও অনৈতিক। সরকারের উচিত যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’ তিনি আরো বলেন, ‘পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সরকারি পরীক্ষণ কাঠামো দুর্বল হওয়ায় এ ক্ষেত্রে দোষীরা পার পেয়ে যায়।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের বিষয় আমার জানা ছিল না। বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। বর্তমান সরকার যত কম মূল্যে সম্ভব ফ্ল্যাট বিতরণ করতে চায়।’ জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান খন্দকার মো. আক্তারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এ দপ্তরে চেয়ারম্যান হিসেবে সম্প্রতি যোগদান করেছি। সব ধরনের অনিয়ম ঠেকাতে কাজ শুরু করেছি। সংস্থার সব বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে সভা করে যাচ্ছি। কোন প্রকল্প থেকে গাড়ি কিনেছে তা আমার পুরোপুরি জানা নেই। তবে যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে তা রোধ করব।’ এনএইচএর সদস্য প্রকৌশল (অতিরিক্ত সচিব) মো. সানোয়ার আলী বলেন, ‘আমার জানা মতে সব প্রকল্প থেকে গাড়ি কেনা হয় না। যেসব প্রকল্পে গাড়ি ধরা থাকে সেখানেই গাড়ি কেনা হয়। আর এসব গাড়ি প্রকল্পকাজে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তার পদাধিকার বলে গাড়ি সুবিধা পাওয়ার কথা তাঁরা গাড়ি পাননি। ফলে এসব প্রকল্প থেকে গাড়ি কিনে কর্মকর্তাদের মাঝে দেওয়া সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে কারো বিলাসিতা করার সুযোগ নেই।’ তবে এ কথা মানতে নারাজ সংস্থার আরেক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ঢাকার মধ্যেও একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর আওতায় একাধিক প্রকল্প হলে প্রতি প্রকল্পের অর্থে একটি করে গাড়ি ক্রয় করা হয়। অথচ একজন প্রকৌশলীর জন্য একটি গাড়ি হলেই যথেষ্ট। মূলত প্রকৌশলীদের নতুন মডেলের গাড়ি পাওয়ার জন্যই এ কাজ করা হয়। তাঁদের পছন্দমতই কখনো এক্স-করোলা বা পাজেরো আবার কখনো পাজেরো স্পোর্টস কার ক্রয় করে থাকেন। এটা কর্মকর্তাদের বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। এভাবে গাড়ি ক্রয় করার ফলে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী থেকে শুরু করে আরো নিচের কর্মকর্তারাও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া প্রকল্পের অর্থে গাড়ি ক্রয় করার পর এর জ্বালানি খরচ প্রকল্প থেকেই নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এ গাড়িগুলোর সব ধরনের খরচ বহন করা হচ্ছে সরকারিভাবে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মোহাম্মদপুর ‘এফ’-ব্লক ফ্ল্যাট প্রকল্প থেকে একটি পাজেরো, মিরপুর ৩৬০ ফ্ল্যাট প্রকল্প থেকে একটি পাজেরো, সিলেট শাহ্জালাল হাউজিং ফ্ল্যাট প্রকল্প থেকে একটি পাজেরো, চট্টগ্রাম হালিশহর ফ্ল্যাট প্রকল্প থেকে একটি পাজেরো, চট্টগ্রাম কাপ্তাই প্লট প্রকল্প থেকে একটি এক্স-করোলা প্রাইভেট কার ও দিনাজপুর ফ্ল্যাট প্রকল্প থেকে একটি পাজেরো কেনা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment