এক শ টাকা ব্যালান্সের কথা বলতে হলে দিতে হবে দুই হাজার টাকা। সেই অনুপাতে কথা বলার সময় ধরে টাকার পরিমাণ ওঠানামা করবে। মা
দকে আসক্তি আছে। কিন্তু বন্দিজীবনে তা কোথায় মিলবে? থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসায় বাড়তি সুবিধা দরকার। কিভাবে সম্ভব? সমস্যা নেই, কেবল দরকার টাকা। অর্থের বিনিময়ে এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে আছেন কারাগারগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ক্ষেত্রে সবাইকে ছাড়িয়ে কারারক্ষীরা। দেশের ৬৮টি কারাগারের চিত্র এমনই। দেশের কারাগারগুলোতে নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতি নতুন নয়। কারাগারের ভেতরে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যবসা, বন্দিদের ওপর নির্যাতন, মাদক বেচাকেনা, খাবার বিতরণে অনিয়ম, বাইরে থেকে বন্দিদের কাছে পাঠানো মালামাল লোপাট, বন্দিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের মতো অনিয়ম-দুর্নীতি দীর্ঘদিনের। এসব রোধে বরাবরই কর্তৃপক্ষীয় পদক্ষেপ একের পর এক ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সময়ে এসে কারাগারগুলোতে মোবাইল ফোন নিয়ে বেপরোয়া ব্যবসা কর্তৃপক্ষের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, রাজনৈতিক নেতা, যুদ্ধাপরাধীসহ সব ধরনের অপরাধীরা কারাগারে প্রকাশ্যেই মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারছেন। মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে কারাগারের ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সিমসহ মোবাইল সেট। বিনিময়ে অর্থ পাচ্ছেন কারারক্ষীরা। কর্তৃপক্ষ ৩৭টি কারাগারকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, গাজীপুরের কাশিমপুর, কুমিল্লা, ফেনী, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, চুয়াডাঙ্গা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অন্যতম। চিহ্নিত কারাগারগুলোতে মোবাইল ফোনে কথোপকথন চলে সবচেয়ে বেশি। কারা অভ্যন্তরে দায়িত্বরত জেল সুপার, জেলর, ডেপুটি জেলর এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিয়মিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। জ্যামার মেশিনের আওতাভুক্ত এলাকায়ও তাঁদের মোবাইল ফোন সচল থাকছে। এ অবস্থায় কারাগারগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বিটিআরসিতে পাঠানো হয়েছে গত ২৫ সেপ্টেম্বর। চিঠিতে কারাগারের মোবাইল নেটওয়ার্ক পুরোপুরি বন্ধে উপায় নির্ধারণের আহ্বান জানানো হয়েছে। কী উপায়ে নেটওয়ার্ক বন্ধ করা যায় এখন তা নিয়ে চলছে আলোচনা। একই সঙ্গে কারাগারে অপরাধ-অনিয়ম রোধে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মোবাইল ফোনে কথা বলা বন্ধ করাসহ অনিয়মগুলো রোধ করা হবেই। তবে কারাগারের প্রশাসনিক এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে রাখার জন্য চিঠিতে বলা হয়েছে। আর বন্দিরা কারা অভ্যন্তরের টিঅ্যান্ডটি বুথ থেকে কথা বলতে পারবে। আশা করি, এর প্রভাব আশপাশের বাসিন্দাদের ওপর পড়বে না।’ এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারাগারে অপরাধসহ অন্যান্য অনিয়ম রোধ করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ করতে বিটিআরসিকে বলা হয়েছে। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে তা কার্যকর হবে। আর এসবে ইন্ধনদাতা হিসেবে কোনো কারা কর্মকর্তা বা রক্ষীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তদন্তপূর্বক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সূত্র জানায়, কারারক্ষী ও ভিআইপি বন্দিদের মাধ্যমে মূলত মোবাইল ফোন ভেতরে ঢুকছে। ভাড়ায় চলছে এসব ফোন। আছে অটোচার্জার। ১০০ টাকা ব্যালান্সের কথা বলতে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বন্দিদের কাছ থেকে। দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা ৩৩ হাজার ৫৭০ জন। অথচ এগুলোতে বন্দির সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে। কোনো কোনো কারাগারে পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি বন্দি রয়েছে। আর যত বন্দি তত বেশি অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থ আদায়ের সুযোগ কারা কর্মচারীদের। আলোচিত রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা বেশির ভাগ সময়ই মোবাইল ফোনে স্বজন ও দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। কাশিমপুর কারাগারে বন্দি ছিলেন এমন এক ছাত্রদল নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, বন্দি অবস্থায় তিনি প্রতিদিন স্বজন, দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ও আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। মুক্তি পাওয়ার দিন ফোনটি তিনি কারাবন্দি এক যুবদল নেতাকে দিয়ে এসেছেন। ঢাকার পাশের এক পৌর কাউন্সিলর জানান, বন্দি অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারায় তাঁর মুক্তি দ্রুত হয়েছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহে আদালতে নেওয়ার পথে পুলিশকে হতাহত করে প্রিজন ভ্যান থেকে পালিয়ে যান তিন শীর্ষ জঙ্গি নেতা। ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ ও গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন যে কারাগারে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পালানোর পরিকল্পনা আঁটে জঙ্গিরা। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস, কামাল পাশা, ফ্রিডম সোহেল ও সুইডেন আসলাম মোবাইল ফোনে মিরপুর, ধানমণ্ডি, শান্তিনগর ও কারওয়ান বাজারের একাধিক ব্যক্তির কাছে চাঁদা দাবি করে। পরে তাদের সহযোগীরা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে আসে। এমনকি তারা ল্যাপটপও ব্যবহার করছে। বন্দিদের বিলাসী জীবনযাপন : কারাগারে বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী, রাজনীতিবিদ ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিলাসী জীবনযাপন করে বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগারে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছে আন্ডারওয়ার্ল্ড। গত ২৪ মার্চ কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে কারা অধিদপ্তরের অভিযানকালে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামসহ কয়েক বন্দির সেল থেকে উদ্ধার করা হয় রঙিন টিভি, সিমসহ মোবাইল ফোনসেট ও মাদক। এরপর গত ২১ এপ্রিল রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অভিযান চালিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমানসহ কয়েকজনের সেলে পাওয়া যায় এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা, মোবাইল ফোনসেট, ইয়াবা ট্যাবলেটসহ অন্যান্য মাদক। এক সপ্তাহের মাথায় ২৮ এপ্রিল কাশিমপুর কারাগারে ফের অভিযান চালিয়ে সাভারের রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার সেল থেকে উদ্ধার করা হয় মোবাইল ফোনসেট। বন্দিদের ওপর নির্যাতন : সব কটি কারাগারেই বিশেষত নিরীহ বন্দিরা নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর বন্দি নির্যাতন বেশি হয় কাশিমপুর কারাগারে। সম্প্রতি ছাড়া পাওয়া মাধবদীর বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাইটার ও কারা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনিয়ম হয়। জামিন পাওয়ার পর ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে- এই ভয় দেখিয়ে তার আত্মীয়দের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এ ছাড়া কারাগারের পিসিতে থাকা টাকাও তিনি ফেরত পাননি। বেশির ভাগ বন্দি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কাশিমপুর কারাগারের জেলার জান্নাতুল ফরহাদ সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। একই অভিযোগ করেছেন উজ্জ্বল নামে অন্য এক কয়েদি। ইতিমধ্যে তিনি কয়েকজন কারা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগও করেছেন। অন্যান্য কারাগারেও একই অবস্থা বিরাজ করছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। অনিয়ম রোধে বসছে সিসি ক্যামেরা : বন্দির নিরাপদ আটক নিশ্চিত, কঠোর নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ, যথাযথভাবে তাদের বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, আত্মীয়স্বজনসহ আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিশ্চিত করা, অপরাধ পুনঃসংঘটনে ঝুঁকি হ্রাস এবং সুনাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার নিয়ম রয়েছে কারাগারগুলোতে। কিন্তু কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না। এসব অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে সব কটি কারাগার সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে। ক্যামেরাগুলো কারাগারের বাইরে ও ভেতরে থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আগামী বছরের মধ্যে সব কারাগারে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে।
No comments:
Post a Comment