গত বছর ডিসেম্বরকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ নবায়নে বিশেষ ছাড় দিয়েছিল। এর ফলে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ১৫ হাজার কোটি টাকা কমে গিয়েছিল। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছিল ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এবারো ৩১ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে খেলাপি ঋণ কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোতে বিশেষ
করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে চলছে খেলাপি ঋণ কমানোর মহোৎসব। ছুটির দিন বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগ খোলা রাখা হচ্ছে। এর বাইরে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও একই উদ্যোগ নিয়েছে। গত মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। ব্যাংক বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালা বলবৎ রেখে এ উদ্যোগ সফল হলে ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত চিত্র আড়াল হয়ে যাবে। আপাতত খেলাপি ঋণ কমে গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে সঙ্কটে পড়বে ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকিং খাতের ঋণশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। ঋণখেলাপিভীতি কমে যাবে গ্রাহকদের মধ্যে। এভাবে কৃত্রিম পদ্ধতিতে আদায় বাড়ানো হলে ভবিষ্যতে সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার মতো সক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমাতে ঋণ নবায়নের নীতিমালা শিথিল করা হয়। অনেকটা ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়ন করা হয়। এর ফলে খেলাপি ঋণ সাড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকায় নেমেছিল। কিন্তু এর পরেই খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে। মার্চ শেষে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয় ৪৮ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এর তিন মাস পর খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে হয় প্রায় সাড়ে ৫১ হাজার কোটি টাকা। এরও তিন মাস পর অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ আরো প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ছয় শতাংশ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি; বরং দিন দিন আরো খারাপ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ৩১ ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র আড়াল করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর ব্যাংকগুলো এ উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ নির্দেশনায়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে, যেকোনোভাবে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। গত ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সাথে বৈঠক করে এ নির্দেশ দিয়েছে। ওই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ যেকোনো উপায়ে ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন। একই সাথে ঋণ নবায়ন, ঋণ অবলোপন ও কিছুটা সুদ মওকুফ করারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনা পাওয়ার পর ব্যাংকগুলো যেকোনো উপায়ে খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ছুটির দিন বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার তাদের অফিস খোলা রাখা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা এখন ঋণ নবায়ন করার কাজ করছেন। অনেক ক্ষেত্রেই ডাউন পেমেন্টের নীতিমালা মানা হচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি ওই সব ব্যাংককে ডেকে নানাভাবে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। জানানো হচ্ছে গভর্নরের ইচ্ছার কথা। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু দিকনির্দেশনাও দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে নমনীয় থাকবে বলে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। তবে কী বিষয়ে নমনীয় থাকবে সে বিষয়ে ওই কর্মকর্তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। রূপালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তাদের ব্যাংক এখন বড় ঋণগ্রহীতাদের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে। পুনর্গঠনের নামে তাদের ঋণ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। ওই কর্মকর্তার মতে, এ প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালার পরিপন্থী। এ ছাড়া ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠাতে ২৫ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ছুটির দিনেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও শাখা খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২৭ ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে পাঠানোরও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের যেকোনো উপায়ে খেলাপি ঋণ তিন হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল চার হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট নগদে না পেলে চেক গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঋণ অবলোপনের ওপরও জোর দেয়া হচ্ছে। নতুন করে কোনো ঋণ যাতে খেলাপি না হয় সে ব্যাপারেও কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে শাখাপর্যায়ে। এসব উপায়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটি। পাশাপাশি বন্ধের মধ্যেও কয়েকটি বিভাগ ও শাখা খোলা রেখে ঋণ পুনঃতফসিল প্রক্রিয়া জোরদার করার পথ বেছে নিয়েছে তারা। এ জন্য আগামী সোম ও মঙ্গলবার দুইটি পর্ষদ সভাও আহ্বান করা হয়েছে। ব্যাংকারদের মতে, বর্তমানে খেলাপি ঋণ কমানোর যে সংস্কৃতি চালু করা হচ্ছে তা ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতকে আরো বেকায়দায় ফেলে দেবে। প্রকৃত আদায় বাড়বে না, বাড়বে কাগুজে আদায়। এতে ব্যাংকের কৃত্রিম মুনাফা বেড়ে যাবে, যা ব্যাংকিং খাত তথা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না। উপরন্তু যারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কষ্ট করে ঋণ পরিশোধ করছেন, তারা আর ঋণ পরিশোধ করতে চাইবে না। এতে ঋণশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
No comments:
Post a Comment