Tuesday, December 30, 2014

অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জি:প্রথম অালো

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। বিজয়ের আগে আগে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। ২৫ মার্চ গভীর রাতে (ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ২৬ মার্চ) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি উপদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে আক্রমণ চালায়। ঘাতক সেনারা অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জিকে জগন্নাথ হলের অ্যাসেম্বলি (বর্তমানে অক্টে
াবর) ভবন থেকে আটকের পর পিঠমোড়া দিয়ে দুই হাত বেঁধে রাখে। ভোরে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে অ্যাসেম্বলি হলের (পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সাময়িক অধিবেশন কক্ষ) কাছে দক্ষিণ বাড়ির কাছে নেয়। সেখানে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় অধ্যাপক অজয় রায়ের রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘খুব সম্ভব ১৯শে মার্চ (৭১) তারিখে শহীদের সাথে আমার শেষ আলাপ হয়। ... কলম্বো প্ল্যানের বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ওর যাবার প্রস্তুতি শেষ-তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ২৬ মার্চ রাতে। জানাল ঐ রাতে বাড়ি যাচ্ছে মাকে দেখতে, খুব সম্ভব ফিরে আসবে ২৪শে বা ২৫ শে মার্চ।... ‘সেই ভয়াল রাত্রে কখন কিভাবে, তিনি শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন, কোনো দিনই প্রকৃত তথ্য জানা যাবে না। তবে পরবর্তীকালে নানা তথ্য ও উৎস থেকে জানা গেছে যে, অনুদ্বৈপায়ন ২৫ মার্চ সকালের দিকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেছিল। ... ২৭ মার্চ কারফিউ উঠলে ছুটে গিয়েছিলাম জগন্নাথ হলে সহকর্মী ও ছাত্রদের অবস্থা দেখবার জন্য, যা দেখেছি বর্ণনার অতীত। ... দেখা হয়েছিল সেখানে দক্ষিণ বাড়ির দারোয়ান মাখনের সাথে (এখন মৃত)। ক্রন্দনরুদ্ধ কণ্ঠে ও অনুদ্বৈপায়নের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানাল: “স্যারকে ওরা পিছমোড়া করে দুহাত বেঁধে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে টেনে নিয়ে যায় অ্যাসেম্বলি ভবনের দিক থেকে, তারপর দক্ষিণ বাড়ির সামনে আরও ২/১ জনের সাথে গুলি করে মারে।”মাখন এ ঘটনা দক্ষিণ বাড়ির কাছে ওর ঘর থেকে লুকিয়ে দেখে ২৬শে মার্চ প্রত্যুষে।’(‘আমার ছাত্র’, অজয় রায়; স্মৃতি: ১৯৭১, ৫ম খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯২, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জি ২৫ মার্চে সিলেট থেকে ফিরে রাতে গিয়েছিলেন অধ্যাপক জালালুর রহমানের পলাশীর মোড়ের বাসায়। তিনি তাঁকে তাঁর বাসায় থাকার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু অত রাতে শিক্ষককে বিব্রত করতে চাননি তিনি। অবিবাহিত অনুদ্বৈপায়ন জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর হিসেবে অ্যাসেম্বলি হলের পাঠাগারসংলগ্ন দুটি কক্ষে থাকতেন। তাঁর মরদেহের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, গণকবরে তাঁকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ১৯৪৫ সালের ৩১ জানুয়ারি সিলেটের নবীগঞ্জ থানার জান্তারী গ্রামে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জির জন্ম। বাবা দিগেন্দ্র ভট্টাচার্জি। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৬১ সালে নবীগঞ্জ জে কে হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি, অনার্স পাস করে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি ডিগ্রি নেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর নিযুক্ত হন। অধ্যাপক অজয় রায়, আলী জাফর, জালালুর রহমান, হিরণ্ময় সেনগুপ্ত ও জগদীশ শুক্ল দাস প্রমুখ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর সরাসরি শিক্ষক। তাঁরা সবাই একবাক্যে বলেছেন তাঁর মতো নিষ্ঠাবান, বিনয়ী ছাত্র এবং পরবর্তীকালে সহকর্মী হিসেবে পাওয়া একটি দুর্লভ ব্যাপার। স্বাধীনতার পর জগন্নাথ হলের অ্যাসেম্বলি হলের নামকরণ করা হয় ‘অনুদ্বৈপায়ন ভবন’। পরে এই ভবন ভেঙে পড়ে। ভবনে চাপা পড়ে নিহত হয় অনেক ছাত্র। পরে সেখানে নির্মিত নতুন ভবনের নামকরণ করা হয়েছে ‘অক্টোবর ভবন’। স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে। গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

No comments:

Post a Comment