দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পে যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রধান কারণ হিসেবে সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারকেই (সিইটিপি) দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলো চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের পথে গত ১০ বছর ধরে একমাত্র বাধা ছিল এই সিইটিপি। এটির কাজ পাওয়া নিয়ে শুরু থেকেই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। একাংশ কাজ পেলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় অন্য অংশ। সিইটিপি স্থা
পনের জন্য প্রাথমিকভাবে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল তা ১০ গুণ বাড়িয়েও নিবৃত্ত করা যায়নি লুটপাটকারীদের। যদিও প্রকল্প পরিচালক সিরাজুল হায়দারের দাবি, সিইটিপির নির্মাণকাজ ৫০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হবে না বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, দীর্ঘ তিন দশকে হাজারীবাগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা চামড়া শিল্প কারখানাগুলো ভালোই চলছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চাপ, হাজারীবাগের পরিবেশ ও বুড়িগঙ্গার পানি রক্ষা এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রেতাদের চাহিদার কথা চিন্তা করে এ শিল্পকে একটি পরিকল্পিত শিল্প সেক্টরে রূপদানের উদ্যোগ নেয় সরকার। সে অনুযায়ী কাজ এগিয়ে যায়। ২০০৪ সালে প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলাকালে প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শনে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী বহুবার সাভারের হরিণধরায় যান। ২০০৬ সালের মধ্যে মাটি ভরাট, লে-আউট, বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপনসহ প্রায় সব কাজই শেষ হয়ে যায়। যদিও বিপত্তি দেখা দেয় কেবল সিইটিপির কাজ নিয়ে। যে প্রতিষ্ঠানকে সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দেয়া হয় তারা কাজ করতে পারছিলেন না নানামুখী প্রতিবন্ধকতার কারণে। এরই মধ্যে ওয়ান-ইলেভেনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে বিপর্যয় নেমে আসে পুরো শিল্পের ওপর। ২০০৭ সালের শুরুতে সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় এসে চামড়া শিল্পনগরীর কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। অনিয়ম খুঁজতে গিয়ে নিজেরাই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আগের কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন কোম্পানিকে সিইটিপি নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই প্রক্রিয়ায় অনিয়মের আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ এলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বন্ধ হয়ে যায় সব কার্যক্রম। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান জোটের শরিক দলের নেতা দিলীপ বড়–য়া। আদালতের জট খোলার পর অনিয়মে জড়ানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধেও। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছরে কোনো কাজ না করেই বিদায় নেন দিলীপ বড়–য়া। অবস্থা এমন হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে একে একে আটজনকে বসানো হয় প্রকল্প পরিচালকের পদে। এ সময় শুধু বরাদ্দ বেড়েছে, সময় বেড়েছে আর প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের পকেট ভরেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নতুন করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর কার্যক্রম জোরদারের উদ্যোগ নেন আমির হোসেন আমু। নতুন করে প্রকল্পব্যয় ও মেয়াদ বাড়ান তিনি। ট্যানারি স্থানান্তরের ব্যাপারে শিল্পমালিকদের সাথে নতুন করে চুক্তিও করান তিনি। সে আলোকে এখন কাজ চলছে। সিইটিপির কাজ ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে পরিচালক সিরাজুল হায়দার নয়া দিগন্তকে বলেন, বরাদ্দপ্রাপ্ত অধিকাংশ কোম্পানিই কারখানার নির্মাণকাজ শুরু করেছে। তারা এখন নিয়মিত কিস্তির টাকাও পরিশোধ করছে। সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এ টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জানা যায়, চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের মোট ব্যয়ের অধিকাংশ যাচ্ছে সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ডসহ কয়েকটি ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে। কয়েক দফা বাড়িয়ে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। উন্নয়ন ও রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এ ছাড়া ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরে শিল্প মালিকদের ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে অনুদান বাবদ রাখা হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। ১৭৫ কোটি টাকা থেকে কয়েক দফায় বাড়িয়ে করা প্রকল্পের মোট ব্যয় এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৮০ শতাংশ বা ৮২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। বাকি ২০ শতাংশ সরকার ঋণ হিসেবে ট্যানারি মালিকদের দেবে যা আদায় করা হবে পরে। ইতোমধ্যে ট্যানারি মালিকেরা ৪৫ কোটি টাকার বেশি সরকারকে পরিশোধ করেছেন বলে জানা গেছে। প্রকল্পের সময়সীমাও বাড়িয়ে করা হয় ২০১৬ সাল পর্যন্ত। বিসিক সূত্রে জানা যায়, সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে বরাদ্দ দেয়া ২০৫টি প্লটে যে ১৫৫টি কারখানা স্থাপিত হওয়ার কথা সেগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত কারখানা স্থানান্তরের লে-আউট পরিকল্পনা জমা দিয়েছেন ১৫২টি ট্যানারির মালিক। এর মধ্যে ১৪১টি ট্যানারি কর্তৃপ নির্মাণকাজের কোনো না কোনো অংশ শুরু করেছে। এগুলোর মধ্যে ৩৩টি কারখানার পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এক তলার কাজও শেষে হয়েছে কয়েকটির। ১৯ দফা তাগাদাপত্র দেয়া হলেও তিনটি ট্যানারি এখনো পর্যন্ত লে-আউট পরিকল্পনাই জমা দেয়নি। কোনো কাজই শুরু হয়নি ১১টির। যদিও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পত্রে অগ্রগতির এ পর্যায়টিকেও সন্তোষজনক বলছে বিসিক। অথচ সরেজমিনে গিয়ে নয়া দিগন্তের এ প্রতিবেদক অগ্রগতির যে চিত্র দেখতে পান তাতে বিসিকের প্রতিবেদনটিকে একটু বেশিই অনুমিত বলে মনে হয়। গত ১৪ ডিসেম্বর সাভার ও কেরানীগঞ্জের মাঝামাঝি হেমায়েতপুরের হরিণধরায় গিয়ে দেখা যায়, ২০০৬ সালের পর প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া চামড়া শিল্পনগরীতে কিছুটা হলেও জনমানুষের পদচারণা শুরু হয়েছে। কয়েকটি প্লট থেকে কানে বাজছিল পাইলিং করার শব্দ। যদিও চোখে পড়ে নামফলক মুছে যাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে গজিয়ে ওঠা গাছ বড় হয়ে যাওয়া, বরাদ্দ নেয়া প্লট জঙ্গল এবং গোচারণভূমিতে রূপান্তরিত হওয়ার বেশকিছু দৃশ্য। আবার সরকারের হুমকি-ধমকির মুখে এবং বরাদ্দ হরানোর ভয়ে কোনো কোনো উদ্যোক্তা সামান্য ইট-বালু ফেলে কাজ শুরু করার প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে বিসিককে জানালেও বালির স্তূপে ঘাস জমে যাওয়া থেকেই নির্মাণকাজ শুরু করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহের অভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্পের রফতানি বাধাগ্রস্ত করতে মহলবিশেষ নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। ফলে চামড়া রফতানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিইটিপি নির্মাণে বারবার বাধা প্রদান এবং নানাভাবে কালক্ষেপণের কাজটিও তারা ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই করেছে বলে জানান তিনি। ছোটখাটো মতপার্থক্য ও ব্যক্তি স্বার্থ ভুলে গিয়ে জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে কাল বিলম্ব না করে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো স্থানান্তর শুরু করতে উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান শিল্পমন্ত্রী। এ েেত্র উদ্যোক্তাদের বাস্তবসম্মত যেকোনো সমস্যা সরকার যথাযথ সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করবে বলে তিনি জানান।
No comments:
Post a Comment