কমলাপুর আইসিডিতে স্টেশনমুখী একটি ট্রেনের সঙ্গে কাভার্ড ভ্যানের সংঘর্ষে ৬ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার পর দায় চাপানো নিয়ে এবারও চলছে পাল্টাপাল্টি। রেল কর্তৃপক্ষ দোষারোপ করছে আইসিডিকে। আইসিডি রেলওয়েকে। উভয় পক্ষই ব্যস্ত কাঁধ থেকে দায়ের বোঝা নামিয়ে দিতে। ফলে কোনো পক্ষই স্বীকার করছে না তাদের ভুলে ঝরে গেল বেশ কিছু তাজা প্রাণ। স্বজনহারা পরিবারগুলো অথবা হাসাপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে তাদের দ
ায়-দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। রেল কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, কমলাপুর কনটেইনার ডিপোটি সংরক্ষিত এলাকা। এখানে বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় এই রেলক্রসিংটির দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ আইসিডি কর্তৃপক্ষের। ওই ক্রসিংয়ে রেলের কোনো গার্ড নেই। কাজেই এ দুর্ঘটনা আইসিডি কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতেই হয়েছে। আইসিডি কর্তৃপক্ষও রেলওয়ের এ সংক্রান্ত প্রায় সব কথা স্বীকার করে নিলেও দুর্ঘটনার দায় নিতে রাজি নয়। তারা বলেছে, রেল যাওয়া-আসার পথে আইসিডি কর্তৃপক্ষের লোকজনই ওই ক্রসিংটি বন্ধ করে থাকে। কিন্তু সোমবার সিগন্যালের সময় হেরফের হওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। বিষয়টি তারা তদন্ত করে দেখছে। ফলে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে এ দুর্ঘটনা, এত মৃত্যু এর দায় কে বহন করবে। আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরানো মানুষগুলোর দায়-দায়িত্ব কে নেবে। এই দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন- মজিবুর রহমান, নবম শ্রেণীর ছাত্র নাইম ইসলাম, আলমগীর হোসেন, ইসমাইল হোসেন ও এক নারীসহ দুজনের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। এদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পুলিশ কমিশনার বেজনীর আহমেদ দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। রেলমন্ত্রী ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, কাভার্ড ভ্যানের চালকই এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। একই সঙ্গে তিনি আইসিডি কর্তৃপক্ষকেও এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, আইসিডি কর্তৃপক্ষ দায়িত্বে অবহেলা না করলে এ দুর্ঘটনাও ঘটত না, সাধারণ যাত্রীদের প্রাণও যেত না। তার পরও তদন্তেই সবকিছু বের হয়ে আসবে। দোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার করে টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন। কমলাপুর আইসিডির ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজার (ডিটিএম) আহমেদুল করিম চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে প্রতিদিন প্রায় ২৮ বার বেসরকারিভাবে পরিচালিত দুই জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। প্রতিবারই দুই টার্মিনালের মাঝে থাকা রেলওয়ে ক্রসিংটি বন্ধ রাখা হয়। একই সঙ্গে ট্রেন আসার ২ মিনিট আগে ক্রসিং সংলগ্ন লোহার পিলারে লাল বাতি জ্বালিয়ে হাই সাউন্ডে হর্ন দেয়া হয়। একই সঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গেটের কাছে নিরাপত্তা বাহিনীর উপপরিদর্শক ও ইনচার্জের রুম আছে। যারা আইসিডির পুরো নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। কোন কাভার্ড ভ্যান যাচ্ছে বা আসছে তারও নম্বর লিখে রাখা হয়। তাহলে কেন এ দুর্ঘটনা? একটি কাভার্ড ভ্যান বেপরোয়া হয়ে কোনো ক্রসিংটি পার হচ্ছিল? এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গেটে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের বাঁশি হর্ন উপেক্ষা করে কাভার্ড ভ্যানটি দ্রুতগতিতে পূর্বদিকের টার্মিনালটিতে যাচ্ছিল। ওই সময়ই দুর্ঘটনাটি ঘটে। তবে ট্রেন আসার ২/৩ মিনিট আগেই গেটটি বন্ধ রাখার কথা। কেন গেট বন্ধ ছিল না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। এ ঘটনায় কাভার্ড ভানের চালককে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত হয়েছে তিন সদস্যের কমিটি। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুর্ঘটনা সম্পর্কে কমলাপুর আইসিডি রেলওয়ে ক্রসিং গেটে দায়িত্বরত নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী উপপরিদর্শক আবুল কাশেম যুগান্তরকে জানান, দুর্ঘটনার সময় তিনি গেট সংলগ্ন রুমের দায়িত্বে ছিলেন। দুুপুর ১টার কিছু পরে আইসিডির পশ্চিম দিক থেকে কাভার্ড ভ্যানটি (ঢাকা মেট্রো-ট-১১-৮৮৫৪) দ্রুতগতিতে ক্রসিং পার হয়ে পূর্ব দিকে যাচ্ছিল। ওই সময় গেটে দায়িত্বরত আনসার সদস্য মিজানুর রহমান ও আবদুল হান্নান গেটের মুখে দাঁড়িয়ে টানা বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। বারবার হাত নাড়িয়ে কাভার্ড ভ্যান চালককে গাড়ি থামানোর সংকেত দেন। ট্রেন আসছে, ট্রেন আসছে বলে তারা চিৎকার করেন। কিন্তু কাভার্ড ভ্যানের চালক ভ্রুক্ষেপ না করে তার গাড়িটি ক্রসিংয়ের ওপর তুলে দেয়। ততক্ষণে ট্রেনটিও ক্রসিংয়ে চলে আসে। আবুল কাশেম জানান, তার চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যেই কাভার্ড ভ্যানটিকে ধাক্কা দেয় ট্রেন। ধাক্কা খেয়ে ভ্যানটি ইঞ্জিনের পেছনের বগির ভেতর ঢুকে পড়ে। এ অবস্থায় ট্রেনটি কাভার্ড ভ্যানকে প্রায় ৫০ ফুট দূরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় আইসিডির লোহার গেট ও দেয়াল ভেঙে পড়ে। একই সঙ্গে মূল লাইনের পাশে থাকা অপর রেল লাইনটিও উপড়ে যায়। এতে ট্রেনটির ইঞ্জিন ও একটি যাত্রীবাহী বগি দুমড়েমুচড়ে যায়। দুর্ঘটনার সময় প্রচণ্ড শব্দে আশপাশের এলাকায় সৃষ্টি হয় এক ভয়ার্ত পরিবেশের। আতংকগ্রস্ত মানুষ কি ঘটেছে তা বুঝতে না পেরে ছোটাছুটি শুরু করেন। আইসিডির লেবার সর্দার জানান, তিনি ট্রেনটিতে করেই নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা আসছিলেন। বসা ছিলেন ইঞ্জিনের সামনে। ট্রেনটি যখন আইসিডি ক্রসিংয়ে পৌঁছায় ঠিক তখন কাভার্ড ভ্যানের সামনের অংশ লাইনের ওপর ওঠে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে সংঘর্ষ নিশ্চিত আঁচ করতে পেরে প্রাণ বাঁচাতে তিনিসহ কয়েক যাত্রী চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দেন। এতে তিনি হাত ও পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পান। ওই অবস্থায় তাকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেয়া হয়। দুর্ঘটনার সময় গেটটি কেন খোলা ছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে আইসিডির নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবুল কাশেম জানান, ‘ওই সময় খোলা গেটটি বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন দায়িত্বরত আনসার সদস্য মিজানুর রহমান ও আবদুল হান্নান। ততক্ষণে কাভার্ড ভ্যানটি লাইনের ওপর উঠে যায়। ট্রাকের ধাক্কায় আনসার সদস্য মিজানুর রহমানও গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে ভর্তি করানো হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ ঘটনায় আরেক আনসার সদস্য আবদুল হান্নানও আহত হয়েছেন বলে তিনি জানান।’ কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে তা বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, কাভার্ড ভ্যানটি বেপরোয়াভাবে রেলগেট পার হওয়ার চেষ্টা করছিল। আনসারদের বাঁশির শব্দেও ভ্যানের চালক গাড়ি থামায়নি। তেমন আনসারদের বাঁশির শব্দ, তাদের তৎপরতা দেখে চালক ট্রেনের গতিও কমাতে পারত। কিন্তু তা না করায় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন। ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মো. সাদেকুর রহমান সাদেক যুগান্তরকে বলেন, কমলাপুর রেলওয়ে আইসিডিতে মূলত ২টি টার্মিনাল রয়েছে। একটি পশ্চিম পাশে, অপরটি পূর্ব পাশে। এ দুটি টার্মিনালের মাঝখানেই রয়েছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জগামী রেলপথসহ আরও ৩টি রেললাইন। একটি টার্মিনাল থেকে আরেকটি টার্মিনালে যেতে হলে ক্রসিংটি পার হতে হয়। ক্রসিংয়ের দু’পাশে দুটি গেটও রয়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে চলাচলকারী যাত্রীবাহী ট্রেন আসার পূর্বে ওই দুটি গেট বন্ধ থাকার কথা। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা যায় ট্রেনটি আসার মুহূর্তে পশ্চিম ও পূর্ব পাশের দুটি গেটই খোলা ছিল। রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন ও মো. খলিলুর রহমান যুগান্তরকে জানান, দুর্ঘটনাকবলিত স্থানের প্রায় ৩শ’ ফুট দক্ষিণে টিটিপাড়া বরাবর একটি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। যে ক্রসিংটির দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। ক্রসিংটিতে রেলওয়ে আনসার বাহিনী ও গেটম্যান রয়েছে। স্টেশনসংলগ্ন দুটি টার্মিনাল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। একটি টার্মিনাল থেকে অন্যটিতে পৌঁছতে মাঝখানে একটি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। যে ক্রসিংটিতে দুর্ঘটনাটির ঘটনা ঘটেছে। তারা বলেন, দুটি টার্মিনালের মাঝের ক্রসিংটির দায়দায়িত্ব রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নয়। এটি সম্পূর্ণ বন্দর কর্তৃপক্ষের, তাদের নিজস্ব জনবল দিয়েই তা পরিচালনা করা হয়। তাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণেই এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। প্রাণ গেছে সাধারণ যাত্রীদের। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে রেলওয়ের। এ জন্য আইসিডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কাভার্ড ভ্যান মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
No comments:
Post a Comment