Saturday, December 20, 2014

বাড়িওয়ালায় পিষ্ট ভাড়াটিয়া:কালের কন্ঠ

রাজধানীর ধানমণ্ডির শংকরে প্রায় সাড়ে ৭০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার চাকুরে জাকির হোসেন বসবাস করেন ওই ফ্ল্যাটে। গত ৪ ডিসেম
্বর বাড়ির মালিক তাঁকে জানিয়ে দেন, জানুয়ারি মাস থেকে বাসার ভাড়া দুই হাজার টাকা বাড়বে। সন্তানের বিদ্যালয় ও নিজের অফিস কাছে হওয়ায় জাকির হোসেনের জন্য বাসাটি সুবিধাজনক স্থানে ছিল। কিন্তু একসঙ্গে দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়ার চাপ সহ্যের ক্ষমতা তাঁর নেই। এখন কী করবেন জাকির হোসেন? ১৯৯১ সালের 'বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন' অনুযায়ী দুই বছরের আগে বাসাভাড়া বাড়ানোর নিয়ম নেই। ভাড়া বাড়ানোর প্রতিকার চেয়ে জাকির হোসেন আদালতে যেতে পারেন। কিন্তু তাঁর কাছে বাড়িভাড়ার চুক্তিপত্র নেই, ভাড়ার রসিদ নেই; এমনকি বাড়ির মালিক যে ভাড়া বাড়ানোর কথা মৌখিকভাবে বলেছেন, এর কোনো প্রমাণও নেই জাকির হোসেনের কাছে। কারণ ঢাকার বাড়ির মালিকরা এসবের কিছুই ভাড়াটিয়াকে দেন না। ফলে আদালতে গেলেও তিনি অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবেন না। আবার আদালতে গেলেই বাড়ির মালিক যেভাবেই হোক, ওই বাসা থেকে তাঁকে বিদায় করবেন। এভাবে ঢাকার ভাড়াটিয়ারা অসহায় বাড়ির মালিকদের কাছে। এক মাসের নোটিশে তাদের ভাড়া বাড়ানো হয়, এক মাসের নোটিশে বাসা ছেড়ে দিতে হয়- আর তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে বাড়ির মালিকের মর্জির ওপর। কত টাকা ভাড়া বাড়বে তাও ভাড়াটিয়ার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে মালিকের ইচ্ছার ওপর। ভাড়া বাসার চাহিদা যেহেতু কখনোই কমে না, তাই বাড়িওয়ালারাও ভাড়াটিয়াদের ওপর ইচ্ছামতো চালাতে পারেন 'ভাড়া নির্যাতন'। এ 'নির্যাতন' মুখ বুজে সহ্য করা অথবা প্রতিবছর বাসা পাল্টানো ছাড়া ভাড়াটিয়াদের কোনো কিছু করার নেই। আবার বাসা পাল্টিয়েই বা যাবেন কোথায়? ভাড়া তো বাড়ে প্রায় সবখানেই। কম ভাড়ায় বাসা পেতে হলে আপনাকে পেছাতে হবে দূরে কোথাও। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ঢাকায় গত ২৪ বছরে (১৯৯০-২০১৩) বাসাভাড়া বেড়েছে প্রায় ৩৭২ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১২ সালে ৯.৭৩ শতাংশ ও ২০১৩ সালে ১০.৯১ শতাংশ ভাড়া বেড়েছে। অবশ্য ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য সেই পাকিস্তান আমল ও পরবর্তী বাংলাদেশে আইন ছিল, এখনো আছে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত অধ্যাদেশ প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৯১ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন হয়। কিন্তু এ আইনের কোনো সুফল কোনো সময় ভাড়াটিয়ারা পায়নি। কারণ আইনটি কার্যকর করতে কোনো সংস্থা কাজ করেনি। ওই আইনে বিভিন্ন এলাকার জন্য ভাড়া নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সরকার জজ আদালতের সহকারী জজদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়োগও দিয়েছে। অভিযোগ গেলে তাঁরা বিচার করছেন, কিন্তু এলাকায় এলাকায় ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, রসিদ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা বা চুক্তি নিশ্চিত করতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। বর্তমান সরকার তার গত মেয়াদে অনেক আইন ও নীতি সংশোধন করেছে; সেগুলো যুগোপযোগী করেছে; কিন্তু বহুলভাবে জনসম্পৃক্ত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ঢাকার এমপিরা সংসদে এ নিয়ে কথা বলেছেন- এমন নজির পাওয়া যায়নি। তাই প্রতিবছর ভাড়া বাড়ছে। ভোক্তা অধিকার কর্মীরা মনে করেন, ভোটের রাজনীতির কারণে কোনো সরকারই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটেনি। তারা সব সময় ১০ শতাংশ বাড়ির মালিকের স্বার্থ দেখেছে, ৯০ শতাংশ ভাড়াটিয়ার স্বার্থ তাদের কাছে উপেক্ষিত। ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, 'যারা আইন তৈরি করে ও কার্যকর করে, তারা বাড়ির মালিক, তাদের একেকজনের একাধিক বাড়ি আছে। আমাদের কথা কেউ শোনে না।' ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ২০১৩ সালে দুই বেডরুমের একটি পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১৫ হাজার ৩৯৫ টাকা। এ ছাড়া একই আয়তনের টিনশেড বাসার ভাড়া ৯ হাজার ২৭০ টাকা, আট বেডের একটি মেস ভাড়া ১৫ হাজার ৭৮৫ টাকা। ওই বছর পাকা বাড়ির ভাড়া বেড়েছে ১৪.৫৫ শতাংশ। ঢাকায় একটি দুই কক্ষের বাসার ভাড়া সরকারি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মাসিক বেতনের সমান। একজন সরকারি বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা চাকরির শুরুতে ১১ হাজার টাকা মূল বেতনে মাস শেষে ১৬ হাজার টাকার মতো হাতে পান। বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মী মাসুদ করিম জানান, ২০১৩ সালে তাঁর বাসাভাড়া ছিল ১৪ হাজার টাকা, ২০১৪-তে তা হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। চলতি মাসে বাড়িওয়ালা আরো দুই হাজার টাকা বাড়িয়েছেন। ২০১০ সালে বেসরকারি সংস্থা 'নাগরিক সংহতি' রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট, হাজারীবাগ, কল্যাণপুর, রামপুরাসহ বিভিন্ন স্থানের ৩০০ ভাড়াটিয়ার মধ্যে একটি জরিপ চালায়। ওই জরিপে দেখা যায়, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়াকে আয়ের অর্ধেক খরচ করতে হচ্ছে বাড়িভাড়ার পেছনে। মিরপুরের সেনপাড়ায় আট ফ্ল্যাটের বাড়ির মালিক এনামুল হক সাতটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেন। তাঁর বাড়ির ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, স্কলাস্টিকা, হারমান মেইনারসহ আশপাশে কয়েকটি স্কুল থাকায় ওই বাসার চাহিদা বেশি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরনোদের রাখার চেয়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা বাড়িয়ে নতুন ভাড়াটিয়া পেতে আগ্রহী এনামুল হক। গত তিন বছরে একাধিক ভাড়াটিয়া পরিবর্তন হয়েছে তাঁর বাড়িতে। গত আড়াই বছরে নানা অজুহাতে ১৭ হাজার টাকার ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়িয়ে করেছেন ২৫ হাজার টাকা! মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তই শুধু নয়, ভাড়া বাড়ানোর জাঁতাকলে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষও। মানুষের বাড়িতে কাজ করেন আলকিনা। তাঁর স্বামী অসুস্থ, তিন সন্তান নিয়ে এক রুম আর গণবাথরুম ও রান্নাঘরে মিরপুর সেনপাড়ায় পর্বতা এলাকার বস্তিতে কোনো রকমে থাকেন তিনি। এ জন্য দুই হাজার ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। বাড়িওয়ালা জানিয়েছেন, সামনের মাস থেকে আড়াই হাজার করে দিতে হবে। শুধু আলকিনা নন, তাঁর বস্তির আরো ১৫ ঘর ভাড়াটিয়াকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ভাড়া বাড়ানোর কথা। ঘরের খোঁজ করছেন আলকিনা। কিন্তু যেখানেই যাচ্ছেন, আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার কমে ঘর পাচ্ছেন না। মালিকদের 'পক্ষে' সরকার : জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৬৪ লাখ। দুই সিটি করপোরেশন মিলে হোল্ডিং সংখ্যা দুই লাখ ৭৯ হাজার। একটি বাড়ির মালিকের পরিবারে গড়ে পাঁচজন করে সদস্য ধরলে ঢাকায় মালিকদের পরিবারের জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৪ লাখ। এ হিসাবে ঢাকায় ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ভাড়াটিয়া। তবে ক্যাব মনে করে, ঢাকায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়াটিয়া। ক্যাবের অভিযোগ, রাজনৈতিক দলগুলো বাড়ির মালিকদের পক্ষ নিয়ে ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ দেখছে না। কারণ এলাকায় বাড়িওয়ালারাই প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের রাজনীতি করে, বাড়িওয়ালাদের হাতে রাখতে চায়। এ জন্য মেয়র প্রার্থীরা ঘোষণা দেন, তিনি নির্বাচিত হলে হোল্ডিং কর বাড়বে না। কিন্তু ভাড়াটিয়াদের জন্য কিছু বলেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, ভোটের রাজনীতির কারণে সরকারও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করছে না। চলতি বাজেট বাস্তবায়নের সময় ২৫ হাজার টাকার বেশি ভাড়া হলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়ার নিয়ম করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ বিষয়ে গত এপ্রিল মাসে সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বলেন, ২৫ হাজার টাকার বেশি বাড়িভাড়া ব্যাংকে আলাদা হিসাব খুলে আদায় করা হলে কত টাকা বাড়িভাড়া খাতে আয় হচ্ছে তা জানা যাবে। আবার ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা করলে ভাড়াটিয়া আইনি আশ্রয় নেওয়ারও সুযোগ পাবে। প্রণয়নকাল থেকেই এ আইনের বিরোধিতা করেন প্রভাবশালী বাড়িওয়ালারা। তার পরও চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয় বিধিটি। কিন্তু প্রভাবশালীরাও থেমে থাকেনি। সেটি বাতিলের দাবি সামনে রেখে সে সময়ে হঠাৎ করেই গড়ে তোলা হয় বাড়িওয়ালাদের সংগঠন 'বাংলাদেশ হোম অ্যান্ড ফ্ল্যাট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন'। জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আইনটি বাতিলের দাবি জানান সংগঠনের নেতারা। কার্যকর করার ২১ দিনের মাথায় নিয়মটি সংশোধনে বাধ্য হয় এনবিআর। সংশোধনীতে বলা হয়, বাড়িওয়ালা ইচ্ছা হলে ভাড়ার টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়েও থাকতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে এনবিআর আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এ নিয়ে ওই সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাড়িওয়ালারা অনেকেই প্রভাবশালী। তাই ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়িভাড়া আদায়ে আইন করে বাড়িভাড়াওয়ালাদের ওপর নজরদারি সম্ভব হয়নি। বাড়ছে না আবাসন : পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় প্রতিদিন এক হাজার ৪১৮ জন করে মানুষ বাড়ছে। এতে ঢাকার জনসংখ্যায় প্রতিবছর যোগ হচ্ছে পাঁচ লাখ মানুষ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রতিবছর প্রায় আড়াই হাজার নতুন ভবনের নকশা অনুমোদন দেয়। ওই সব ভবনকে গড়ে ছয় তলা ও দুই ইউনিট ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, নতুন ভবনে প্রায় ৩০ হাজার ফ্ল্যাট হয়। প্রতি ফ্ল্যাটে পাঁচজন করে মানুষ থাকলে বছরে ঢাকায় আবাসন হয় দেড় লাখ মানুষের। চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য না থাকায় প্রতিবছরই ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ পান বাড়িওয়ালারা। কী করার আছে : ভলান্টারি কনজ্যুমার ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়্যারনেস সোসাইটির (ভোক্তা বাংলাদেশ) নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান বলেন, ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ১৯৯১ সালের আইন সংশোধন করতে হবে, ওই আইন প্রয়োগের জন্য বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। সহকারী জজদের বদলে এলাকাভিত্তিক ভাড়া নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করতে হবে। ভাড়াটিয়াদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, অবিবেচকের মতো ভাড়া বাড়ানোয় কিছু বাড়িওয়ালাকে শাস্তির আওতায় এনে তা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলে অন্যরা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানো কমিয়ে দেবে।    

1 comment:

  1. খুব এ ভাল লাগল নিয়মগুলো পড়ে।তাছাড়া ভাড়াটিয়া আর বাড়ীওয়ালা সাথে ভাল সম্পর্ক একটি গুরুত্তপূর্ণ দিক।বাড়ী ভাড়ার নিয়ম সম্পর্কে যদি বাড়ীর মালিক ও ভাড়াটিয়া কোন কিছু না জেনে বাড়ী ভাড়া নেই ও দেয় সেই ক্ষেত্রে বাড়ীর মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়পক্ষ বিপদের সম্মুক্ষিণ হতে পারেন।বাড়ি ভাড়া নেওয়ার আগে কিছু করণীয় কাজ রয়েছে।বাড়ি ভাড়া আইন সম্পর্কে আর ও বিস্তারিত আমি এই ওয়েবসাইটে পড়েছিলাম।

    ReplyDelete