Saturday, March 28, 2015

নগরজীবনে আপন ঘরেই নিরাপত্তাহীন প্রবীণরা:কালের কন্ঠ

একটু ভালো করে বাঁচার আশায় জীবনের বেশির ভাগ সময় দৌড়ঝাঁপ করে কাটিয়েছেন তাঁরা। সংসারে সচ্ছলতা আনতে দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন, সন্তানদের মানুষ করেছেন। সেই ব্যস্ত মানুষগুলোই অবসর জীবনে বড় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। ঘরের চার দেয়ালের মাঝে অনেকটা বন্দি জীবন কাটে তাঁদের। রাজধানীতে বসবাসরত হাজারো প্রবীণের একই অবস্থা। কেউ পরিবারের সঙ্গে থেকেও একা, আবার স্বজন দূরে থাকায় বাধ্য হয়ে অনেককে বেছে নিতে হয় একাকী জীবন।
তবে শেষ জীবনে এসে প্রিয় ঘরই তাঁদের জন্য হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। ঘরের ভেতরেই দুর্বৃত্তের হামলায় নির্মমভাবে হত্যার শিকার হচ্ছেন প্রবীণরা। রাজধানীতে একের পর এক ঘটছে এ রকম ঘটনা। কখনো গলা কেটে হত্যা করা হচ্ছে, কখনো বা উদ্ধার করা হচ্ছে হাত-পা বাঁধা লাশ। গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে নিজের ঘরে খুন হয়েছেন অর্ধশতাধিক প্রবীণ ব্যক্তি। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাসায় রাখা টাকা, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটের জন্যই প্রবীণদের হত্যা করা হচ্ছে। শুধু ডাকাতরাই নয়, পরিচিতরাও খুনির ভূমিকায় নামছে। কখনো গৃহকর্মী, কখনো গাড়িচালক, কখনো নিরাপত্তাকর্মী; আবার কখনো স্বজনদের নির্মমতার শিকার হচ্ছেন প্রবীণরা। তাঁদের নিঃসঙ্গ জীবনের সুযোগ নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে তিন ডজন ঘটনার অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে একই রকম তথ্য। রাজধানীতে সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত মঙ্গলবার। উত্তর যাত্রাবাড়ীর কলাপট্টিতে নিজ বাসায় সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী রওশন আরাকে গলা কেটে হত্যা করে তাঁরই বাসার গৃহকর্মী লাকি আক্তারের ছেলে সাঈদ হাওলাদার ও তার সহযোগী রিয়াজ। রওশনকে হত্যার দৃশ্য দেখে ফেলায় নিজের বোন কল্পনাকেও হত্যা করে সাঈদ। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ কর্মকর্তারা এ তথ্য জানান। রওশন আরার সন্তানরা বিদেশে থাকেন। তিনি গৃহকর্মীদের নিয়ে একাই বাড়িতে থাকতেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তারা বলছেন, বাসাবাড়িতে লুট ও প্রবীণদের হত্যার বেশির ভাগ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন তাঁরা। তবে সন্দেহভাজনদের পরিচয় না পাওয়ায় অনেক সময় বিপত্তিতে পড়তে হয় তদন্তকারীদের। তাই প্রবীণদের নিরাপত্তার বিষয়ে পরিবারের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি কর্মচারী নিয়োগে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। গত ১ মার্চ রাতে রামপুরার বাসায় অবসরপ্রাপ্ত কর কমিশনার আবু তাহেরকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পরে তাঁর গাড়িচালক নাছির ও তার সহযোগী রাসেলকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। পুলিশ জানায়, আটজন মিলে নাছিরের স্ত্রীকে বেঁধে তাঁকে হত্যা করে। পরে বাসা থেকে ১২ ভরি সোনা ও ৪৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়। গত ৩০ জানুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার মহানগর আবাসিক এলাকার বাসায় খুন হন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রয়াত আখতার-উল-আলমের মেয়ে ফাহমিদা আখতার বিথুন। নিজের ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, পরিচিত কেউ টাকা ও সোনার অলংকার লুটের উদ্দেশ্যে হত্যা করেছে তাঁকে। গত বছরের ২৭ অক্টোবর মিরপুরে বাসায় ঢুকে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বৃদ্ধা হোসনে আরাকে। বাসা থেকে খোয়া যায় দুই লাখ টাকা। ঘটনার পর থেকে হোসনে আরার বড় ছেলে দেলোয়ার হোসেনের ওয়ার্কশপের কর্মচারী রাকিব ও তার দুই বন্ধু পলাতক। দেলোয়ার বলেন, 'আমার বাসায় সব সময় টাকা থাকত। মা বাসায় একা ছিলেন। তাই ঘটনা ঘটিয়ে ওরা (রাকিব ও তার বন্ধুরা) পালিয়ে যায়। আমি রাকিবের ঠিকানা রাখিনি। তাই মায়ের খুনিদের খুঁজে পাইনি।' মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার এসআই ইমানুর রহমান বলেন, 'রাকিবকে ঘিরেই রহস্য দেখা দিয়েছে।' ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর রামপুরার ওয়াপদা রোডে নিজের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় প্রবীণ ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদের হাত-পা বাঁধা লাশ। তিনিও বাড়িতে একাই থাকতেন। ঘটনার পর তাঁর গাড়িচালক হুমায়ুন কবিরকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানিয়েছে, টাকা লুটের জন্যই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট রামপুরার বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয় সিআইডির অবসরপ্রাপ্ত এএসপি ফজলুল করিমকে। টাকা লুটের জন্যই দুর্বৃত্তরা তাঁকে খুন করেছে বলে জানায় পুলিশ। ২০১২ সালের ৩১ জুলাই দক্ষিণখানের নিজ বাড়িতে সেনাবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার নাছির উদ্দিনকে কুপিয়ে এবং তাঁর স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মুক্তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিন বছরেও এই জোড়া খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। ওই দম্পতির মেয়ে শাহনাজ বেগম কাকন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার বৃদ্ধ মা-বাবাই শুধু ওই বাড়িতে থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে কারো বিরোধ থাকার কথা নয়। কেন তাঁরা খুন হলেন, তা আজও জানলাম না। বাসা থেকে তিন-চার ভরি স্বর্ণালংকার খোয়া গেছে। হয়তো কিছু টাকাও ছিল।' ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মিরপুরে বাসায় খুন হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষক মাহবুব-ই-সাত্তারের স্ত্রী ও হাইকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী রওশন আক্তার। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী তাজুল ও রাসেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ জানায়, তারা টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের জন্যই হত্যা করে রওশনকে। দুজন চাকরি করার জন্য ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেছিল। ২০১১ সালের ১ এপ্রিল রাতে মিরপুরের ১ নম্বর সেকশনের সি ব্লকের ১৫ নম্বর বাড়িতে গলাকেটে হত্যা করা হয় বৃদ্ধা নূরজাহান বেগমকে। বাড়ির মালিক নূরজাহানও বাসায় একা থাকতেন। নূরজাহানের ছেলে মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, তাঁর মায়ের সঙ্গে কারো শত্রুতা ছিল না। খুনিরা তাঁর মায়ের হাতে থাকা সোনার দুটি বালা ও গলার চেইন নিয়ে যায়। ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানীর ইন্দিরা রোডের ১৬/এফ নম্বর ভবনের নিজ ফ্ল্যাট থেকে বৃদ্ধা ভার্জিনিয়া রোজারিও এবং তাঁর ছেলে ভ্যালেন্টাইন রোজারিও মিল্টনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায়, টাকার জন্যই ওই জোড়া খুন হয়। একই বছর ২৮ জানুয়ারি ৭৭ নয়াপল্টন মসজিদ গলির ভাড়া বাসা থেকে দৈনিক জনতার সিনিয়র সহসম্পাদক ফরহাদ খাঁ ও তাঁর স্ত্রী রহিমা খানমের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ফরহাদ খাঁর বোনের ছেলে নাজিমুজ্জামান ইয়নকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জানা যায়, টাকার জন্যই মামা ও মামিকে হত্যা করে ইয়ন। ২০১২ সালের ২৯ জুলাই গুলশানে নিজ বাসায় ব্যবসায়ী ফজলুল হককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। বাড়ির সাত কর্মচারীকে গ্রেপ্তার কর পর রহস্য উদ্ঘাটন করে পুলিশ। লুটের জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়। ২০১০ সালের যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কের বাসায় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মিল্টন, তাঁর মা সুফিয়া খাতুন ও স্ত্রী বিথী রহমানকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মিল্টনের ভাই লিঙ্কন ও ভাতিজা সুমনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছে ডিবি পুলিশ। মাদকাসক্ত সুমন টাকার লোভেই এ হত্যা করে বলে জানা যায়। ২০১১ সালে ধানমণ্ডির বাসিন্দা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট নাজির আহমেদ খান, কলাবাগানে সড়ক ও জনপথের সাবেক প্রকৌশলী, গ্রিন রোডে এনজিও কর্মকর্তা এবং পল্লবীতে শিক্ষিকা আকলিমা আক্তার খুন হন নিজেদের বাসায়। জানা গেছে, ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শাহীনবাগের বাসা থেকে গৃহকত্রী শামীম আরা বেগমের লাশ উদ্ধারে পর পালিয়ে যায় গৃহকর্মী পারভীন। ২০১০ সালের ৮ মে বনানীর ২৭ নম্বর রোডের ৭ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় এ-১ নম্বর ফ্ল্যাটে নাছরিন নামে গৃহকর্ত্রীকে খুন করে গৃহকর্মী লিজা পালিয়ে যায়। একই দিন কলাবাগানে গৃহকর্মী নূর ইসলামের হাতে খুন হন প্রকৌশলী গোলাম রহমান। এমন বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের পর গৃহকর্মী ও গাড়িচালকদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহের পদক্ষেপ নেয় ডিএমপি। ২০১১ সালে এলাকার কমিউনিটি পুলিশ ও বিট পুলিশের মাধ্যমে তালিকা সংগ্রহ করতে বলা হয় স্থানীয় থানার ওসিকে। সূত্র জানায়, ২০০৭ সালেও ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে ভাড়াটিয়াদের ছবি সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় ফরম পাঠানো হয়েছিল। তবে ওই কার্যক্রমটি পরে আর বাস্তবায়ন হয়নি। ডিএমপির উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মাসুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাসা-বাড়িতে যারা একা থাকেন, বিশেষ করে প্রবীণদের ব্যাপারে সবারই সচেতন হওয়া উচিত। তাঁদের নিজস্ব নিরাপত্তা জোরদার করা উচিত। তবে এ ধরনের অপরাধ নিয়ে নগরবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। বাসায় সংঘটিত বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের খুনি শনাক্ত করতে পুলিশ সক্ষম হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধে বাড়ির দারোয়ান, ড্রাইভার ও কর্মচারী নিয়োগের সময় তথ্য যাচাই করে রাখা উচিত। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।'    

3 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. দূর্ঘটনা একটি প্রতিদিনের ঘটনা।প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দূর্ঘটনা ঘটছে।দূর্ঘটনা হ্যে যাওয়ার পর পুলিশ যখন ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাই করে তখন বেশিরভাগ ড্রাইভারের কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকে না।

    ReplyDelete
  3. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete