Wednesday, June 17, 2015

ঘাতক পতাকাধারীর প্রাণদণ্ড বহাল:কালের কন্ঠ

একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে তখনকার আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সেক্রেটারি জেনার
েল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুটি অভিযোগ মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ একটিতে (শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যা) মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেন। আলবদর বাহিনীর নেতা হিসেবে মুজাহিদের এ শাস্তি হলো। এ ছাড়া মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির এই প্রথম মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ ঐকমত্যের ভিত্তিতে গতকাল মঙ্গলবার এ রায় দেন। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এই প্রথম বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার সম্পন্ন হলো। উভয় পক্ষের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে গতকাল প্রধান বিচারপতি রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ পড়ে শোনান। এ বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এ রায়ের মধ্য দিয়ে আপিল বিভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধের চতুর্থ মামলায় রায় দিলেন। এর আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মামলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে রায় দেওয়া হলেও এই প্রথম সর্বসম্মতভাবে রায় দিলেন আপিল বিভাগ। ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের উত্থাপিত সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় সেগুলোতে সাজা দেওয়া হয়। ওই পাঁচ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেন মুজাহিদ। এসবের মধ্যে চারটি অভিযোগ আপিল বিভাগে প্রমাণিত হয়েছে। প্রমাণিত অভিযোগের মধ্যে ষষ্ঠ অভিযোগে (বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড) মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া সপ্তম অভিযোগে (বাকচরে হিন্দুদের হত্যা ও নিপীড়ন) ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ তা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারদণ্ড দিয়েছেন। তৃতীয় অভিযোগে (ফরিদপুরের রণজিৎ নাথকে আটক রেখে নির্যাতন) ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং পঞ্চম অভিযোগে (নাখালপাড়া সেনাক্যাম্পে আলতাফ মাহমুদ, রুমী, বদি, আজাদ, জুয়েলকে নির্যাতন ও পরে হত্যা) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন। প্রথম অভিযোগ (সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন অপহরণ ও হত্যা) থেকে মুজাহিদকে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ট্রাইব্যুনাল এই অভিযোগটি বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগের সঙ্গে মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন মুজাহিদকে। দ্বিতীয় (ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে হিন্দু গ্রামে গণহত্যা) ও চতুর্থ (আলফাডাঙ্গার আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে আটকে রেখে নির্যাতন) অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে খালাস দেওয়ায় এ দুটি অভিযোগ আপিল বিভাগে বিচার্য ছিল না। তাই এ দুটি অভিযোগে আপিল বিভাগ কোনো রায় দেননি। অ্যাটর্নি জেনারেলের সন্তোষ : আপিল বিভাগের এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সরকারপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রায়ের পর তিনি নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার উসকানিদাতা ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন আলবদর নেতা মুজাহিদ। তিনি বলেন, 'তারা যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে সেসব বুদ্ধিজীবী এক শতাব্দীতে পাওয়া যাবে না। তাঁদের আমরা ফিরে পাব না। তবে এ রায়ে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পাওয়া যাবে যে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হয়েছে।' অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ রায়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সব নাগরিক খুশি হবে। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা নেই যে নিজেরা নিজ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। কিন্তু একাত্তরে তাই ঘটেছে। আলবদররা এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। হিটলারের হিংস্রতা আর এদের হিংস্রতার মধ্যে কোনো তফাত নেই। খন্দকার মাহবুবের দাবি, ঢালাও অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড : অন্যদিকে মুজাহিদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ঢালাও অভিযোগের ওপর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল না এ মামলায়। এর পরও আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছেন। এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর তা পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করা হবে। রিভিউ আবেদন করার সুযোগ : আপিল বিভাগের এ রায়ের পর রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করার সুযোগ পাবেন মুজাহিদ। রিভিউ আবেদন করতে চূড়ান্ত রায় প্রকাশের দিন থেকে ১৫ দিন সময় পাবেন তিনি। রিভিউ আবেদন করার পর তা খারিজ হলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে ক্ষমার আবেদন করার সুযোগ পাবেন মুজাহিদ। রাষ্ট্রপতির কাছে এ আবেদন করা হলে এবং রাষ্ট্রপতি তা খারিজ করলে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আইনগত কোনো বাধা থাকবে না। এর আগে আপিল বিভাগে যে দুজন (কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামান) রিভিউ আবেদন করেছিলেন তাতে আপিল বিভাগের রায়ে কোনো হেরফের হয়নি। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করেই তাঁদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। মুজাহিদের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। এরই মধ্যে আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেওয়া রায়ে রিভিউ করার বিষয়ে দিকনির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন থেকে রিভিউ আবেদন করতে ১৫ দিন সময় পাবে সংশ্লিষ্টপক্ষ। কাদের মোল্লার পক্ষে রিভিউ আবেদন করা হলে কয়েক দিন শুনানির পর ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তা খারিজ হয়। সেদিন রাতেই কাদের মোলার রায় কার্যকর হয়। এর প্রায় এক বছর পর ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর ওই রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এ রায়ে আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেন, যেকোনো পক্ষ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবে। তাতে বলা হয়, আসামিকে সার্টিফায়েড কপি দেওয়া অথবা তাঁকে মৃত্যু পরোয়ানা জানানোর দিন থেকে ১৫ দিন গণনা শুরু হবে। এর মধ্যে যেটি আগে হয় সেটিকে ধরেই রিভিউ আবেদন করতে হবে। কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় দেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রায়ে সই করেন বিচারকরা। ওই দিনই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এ রায়ের কপি পাওয়ার পর ১৯ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এ পরোয়ানা পেয়ে সে দিনই কারা কর্তৃপক্ষ কামারুজ্জামানকে পরোয়ানার কথা অবহিত করে। এর ঠিক ১৫ দিনের মাথায় এসে গত ৫ মার্চ রিভিউ আবেদন দাখিল করেন কামারুজ্জামান। এ রিভিউ আবেদনের ওপর ৫ এপ্রিল শুনানি হয়। ৬ এপ্রিল তা খারিজ হয়। এ খারিজ আদেশের কপি প্রকাশিত হয় ৮ এপ্রিল। সে দিনই তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ট্রাইব্যুনাল সে দিনই তা কারাগারে পাঠিয়ে দেন। তবে কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য সময় পান। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলার পর ১১ এপ্রিল রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। মুজাহিদের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। আপিল বিভাগে যেসব অভিযোগ প্রমাণিত : আপিল বিভাগে প্রমাণিত ষষ্ঠ অভিযোগটি হলো বুদ্ধিজীবী হত্যার। এতে বলা হয়, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। রাজাকার ও আলবদর বাহিনী সেখানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে সেখান থেকে অপরাধজনক নানা কার্যক্রম চালায়। মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হওয়ায় ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তিনি ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর নেতা হিসেবে সেখানে উপস্থিত পাকিস্তান সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুজাহিদ গণহত্যা, হত্যা, নির্যাতন, দেশান্তর, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মানবতবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন। গতকাল আপিল বিভাগ এ সাজা বহাল রাখেন। সপ্তম অভিযোগে (বকচরে গণহত্যা) বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে। সেখানে বীরেন্দ্র সাহা, উপেন সাহা, জগবন্ধু মিস্ত্রি, সত্য রঞ্জন দাশ, নিরোদ বন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্রকে আটক করা হয়। পরে তাঁদের হত্যা করে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার মেয়ে ঝুমা রানীকে ধর্ষণ করে। অনিল সাহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। মুজাহিদের প্রত্যক্ষ মদদ ও নির্দেশে এ অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও গতকাল আপিল বিভাগ সেই সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ, সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে আর্মি ক্যাম্পে যান। সেখানে তাঁরা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জাহানারা ইমামের ছেলে শাফী ইমাম রুমী, বদিউল আলম বদি, মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালালকে দেখে তাঁদের গালাগাল করেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন, 'প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই এঁদের হত্যা করতে হবে।' এরপর মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় বিচ্ছু জালাল ছাড়া অন্য বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করেন এবং তাঁদের লাশ গুম করেন। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মুজাহিদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। গতকাল আপিল বিভাগ এ অভিযোগে সাজা বহাল রাখেন। তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে কোনো একদিন ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামটের (রথখোলার) রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। এরপর ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউসে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মুজাহিদ পাকিস্তানি সেনা অফিসার মেজর আকরাম কোরাইশীর সঙ্গে কথা বলার পর বাবু নাথের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর একটি দাঁত ভেঙে ফেলা হয়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আবদুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে আটকে রাখে রাজাকাররা। পরে রাতে বাবু নাথ সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচেন। এ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ এ সাজা বহাল রেখেছেন। আপিলে যে অভিযোগ থেকে খালাস : মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগটি ছিল সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন অপহরণ ও হত্যার। এতে বলা হয়, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর ৫ নম্বর চামেলীবাগের বাসা থেকে ইত্তেফাকের তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। মুজাহিদের পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন সাত-আটজন যুবক তাঁকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। এরপর তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই অভিযোগটি মুজাহিদের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালে। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন যেহেতু একজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন তাই ষষ্ঠ অভিযোগের সঙ্গে এটা মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। গতকাল আপিল বিভাগ শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। আর সিরাজুদ্দীন হোসেন অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ থেকে মুজাহিদকে খালাস দিয়েছেন। 'আপিল ইজ অ্যালাউড ইন পার্ট' : গত ২৭ মে আপিল বিভাগে এ মামলায় উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায়ের জন্য দিন ধার্য করা হয় ১৬ জুন। গতকাল সকাল ৯টায় আপিল বিভাগের এক নম্বর বেঞ্চে একে একে এজলাসে বসেন প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিরা। এর কয়েক মিনিট পর ৯টা ৬ মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় দেওয়া শুরু করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, 'আপিল ইজ অ্যালাউড ইন পার্ট।' মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে সংক্ষিপ্ত আদেশ পাঠ করেন প্রধান বিচারপতি। ওই সময় মুজাহিদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান, অ্যাডভোকেট মো. শিশির মুনির এবং সরকারপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজউদ্দিন ফকির, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুলসহ বেশ কয়েকজন আইন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন মুজাহিদের তিন ছেলে। ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই এক রায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তিনটিতে মৃত্যুদণ্ড, একটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও একটিতে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে মুজাহিদ ওই বছরের ১৭ আগস্ট আপিল করেন। এ আপিলের ওপর গত ২৯ এপ্রিল শুনানি শুরু হয়ে ২৭ মে পর্যন্ত মোট ৯ কার্যদিবস শুনানি হয়। যেভাবে বিচার : ২০১১ সালের ১ নভেম্বর মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রসিকিউশন একই বছরের ১১ ডিসেম্বর মুজাহিদের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল করে। কিন্তু তা যথাযথ না হওয়ায় একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর ফেরত দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি পুনরায় ফরমাল চার্জ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। একই বছরের ২৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এরই মধ্যে দুই নম্বর ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে মামলাটি ওই বছরের ২৫ এপ্রিল সেখানে স্থানান্তর করা হয়। এরপর উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ২০১২ সালের ২১ জুন অভিযোগ গঠন করা হয় মুজাহিদের বিরুদ্ধে। ওই বছরের ২৬ আগস্ট শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাকসহ মোট ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। অন্যদিকে ২০১৩ সালের ৫ মে মুজাহিদের পক্ষে একমাত্র সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তাঁর ছোট ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর। যদিও আসামিপক্ষে তিনজন সাফাই সাক্ষী দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অন্য কেউ সাক্ষ্য দিতে আসেননি। উভয় পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০১৩ সালের ৭ মে থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। উভয় পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষে ওই বছরের ৫ জুন রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। এরপর ১৭ জুলাই রায় ঘোষণা করা হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মুজাহিদ গ্রেপ্তার হন। একই বছর ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি কারাবন্দি। মুজাহিদ বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।

No comments:

Post a Comment