Tuesday, July 22, 2014

কমলাপুর স্টেশনে বিনিদ্র রজনী:প্রথম অালো

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের বি এম মাহমুদুল হক বিসিএস পরীক্ষা দেবেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ‘বাংলাদেশ অ্যাফেয়ার্স’ বই থেকে রাত জেগে জরুরি তথ্য মুখস্থ করছেন তিনি কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির সঙ্গে অবশ্য রেলস্টেশনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর এই অধ্যয়নপর্বের সঙ্গে রেলস্টেশনের সংক্ষিপ্ত সম্পর্কটি স্থাপিত হয়েছে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগাম টিকিট সংগ্রহ উপলক্ষে। গত রোববার রাত সাড়ে
১১টায় তিনি টিকাটুলীর বাসা থেকে কমলাপুর স্টেশনে আসেন পরের দিন সোমবার সকাল থেকে দেওয়া টিকিট সংগ্রহের জন্য। সারা রাত জাগতে হবে। হাতে করে বইটি এনেছিলেন। জ্ঞানান্বেষণের মধ্য দিয়ে কেটেছে তাঁর বিনিদ্র রজনী। গতকাল সোমবার সকাল সাতটায় কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল, আগাম টিকিট সংগ্রহ করতে শত শত লোক রাত জেগে কাউন্টারের সামনে সারি দিয়ে আছেন। তাঁদের কেউ ১০ ঘণ্টা, কেউ ১৫ ঘণ্টা, এমনকি কেউ কেউ ২০ ঘণ্টার বেশি সময় হত্যে দিয়ে আছেন কাউন্টারের সামনে। বিচিত্র এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে স্টেশনে। দেখে মনে হয় বাস্তুহারা একদল শরণার্থী এসে আশ্রয় নিয়েছে স্টেশনের ছাউিনর তলায়। কেউ মাদুর পেতে কাত হয়ে আছেন। কেউ খবরের কাগজ পেতে তার ওপর বসে বসে ঝিমুচ্ছেন। কেউ বা আবার মনোযোগী দিনের শুরুতে খবরের কাগজের পাতায়। টিকিট ছাড়া হবে সকাল নয়টায়। সময় যেন আর যাচ্ছে না। ওদিকে আবার থেকে থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। আগের রাত ১০টায় এসেও বাবুল হোসেনের সিরিয়াল নম্বর ১৭৫। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের ছাত্র। বড় দুলাভাই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষক। শ্যামলীতে তাঁদের সঙ্গেই থাকেন বাবুল। জামালপুরের মেলান্দহ তাঁদের বাড়ি। তিনটি টিকিট নিতে এসেছেন তিনি। এই সিরিয়াল নম্বর অবশ্য স্টেশন কর্তৃপক্ষের দেওয়া নয়। নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই এ ব্যবস্থা করেছেন। দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের যাত্রী অ্যারিস্টোফার্মার চাকুরে শাজাহান সিরাজ জানালেন, রোববার ইফতার করেই তিনি টিকিট নিতে এসেছেন। সারা রাত থাকতে হবে। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। রাতের খাওয়া, সেহ্রি খাওয়া, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়া এমন বহুবিধ প্রয়োজনেই লাইন থেকে সরে যেতে হয়। কাজেই তাঁরা নিজেরাই কয়েকজন মিলে খাতা কিনে ক্রমিক নম্বর দিয়ে সারিতে দাঁড়ানো লোকদের নামের তালিকা করেছেন। একটি কাগজের টুকরায় সেই নম্বর লিখে প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে। একই কায়দায় প্রতিটি রুটের কাউন্টারের সামনের সারিতে তৈরি হয়েছে নিজ উদ্যোগের এই ‘সিরিয়াল’। সবাই তো আর বিসিএস পরীক্ষা দেবেন না। কাজেই ‘অধ্যয়নং তপঃ’ তত্ত্বে আগ্রহী ব্যক্তিদের সংখ্যা এখানে বিরল। সময় কাটানোর জনপ্রিয় প্রক্রিয়া ছিল তাস পেটানো। সিলেটের হবিগঞ্জের টিকিট নিতে আসা জালাল উদ্দিনের সিরিয়াল ৩৩। তিনি জানালেন, রাতের খাবার, সেহ্রির খাবার মিলয়ে ২০০ টাকার মতো খরচ হয়েছে। বাসা থেকেই তাসের প্যাকেট সঙ্গে এনেছিলেন এই দূরদর্শী (অনেকে এখানে এসে তাস কিনেছেন)। ‘টোয়েন্টি নাইন’ খেলে সময় কাটিয়ে দিয়েছেন। রোববার ২০ জুলাই থেকেই এবার ঈদের আগাম টিকিট দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রথম দিনে দেওয়া হয়েছে ২৪ জুলাইয়ের টিকিট। গতকাল ২১ জুলাই দেওয়া হয় ২৫ জুলাইয়ের টিকিট। আগাম টিকিট দেওয়া হবে ২৪ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে টিকিট দেওয়া শুরু হয়। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টিকিট দেওয়ার কথা। অনেকেই নিজে না এসে ব্যক্তিগত গাড়ির চালক, অফিসের কর্মচারী, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভাই-ভাগনেদের পাঠিয়েছেন। সাদ্দাম হোসেন নামের এমন একজনকে পাওয়া গেল । তিনি একটি কাস্টমস ক্লিয়ারিং ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) অফিসে কাজ করেনে। তাঁর বসের বাড়ি জামালপুর। রোববার সকাল নয়টায় সাদ্দাম কমলাপুর এসেছেন। টিকিট কাটা উপলক্ষে তাঁর তিন দিনের ছুটি। খরচ হিসেবে ৫০০ টাকা দিয়েছেন বস। মাঝেমধ্যেই ফোন করে জেনে নিচ্ছেন হালনাগাদ অবস্থা। ১ নম্বর সিরিয়ালে ছিলেন, এমন এক সৌভাগ্যবানের সঙ্গে কথা হলো। তিনি মুশফিকুর রহমান। বয়সে প্রৌঢ়। থাকেন বৌদ্ধমন্দিরের পাশে। যাবেন কুমিল্লা। রোববার সকাল থেকে পড়ে আছেন স্টেশনে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা। সকাল নটায় প্রথম টিকিটি হাতে পেয়ে তাঁর এক লাইনের প্রতিক্রিয়া হলো, ‘ভাই, আল্লাহ রহমত করছে।’ সকাল নটায় টিকিট দেওয়া শুরু হলে চট্টগ্রামের কাউন্টারের সামনের সারিতে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নিরাপত্তারক্ষীরা বেশ তৎপরই ছিলেন। দ্রুতই তাঁরা আবার সারির শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এত কষ্টক্লেশ, এত ভিড়ভাট্টার ধকল সয়ে কেন যান তাঁরা, উত্তর নতুন কিছু নয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অফিস সহকারী শরিফ হোসেন বললেন, ‘প্রায় সাত দিন ছুটি হচ্ছে এবার। বাড়িতে মা-বাবা আছেন। ভাইয়েরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসবেন। অনেক বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হবে। বছরের এই সময়ে না গেলে সবার সঙ্গে তো আর দেখা হয় না। তাই যাচ্ছি।’ কাজেই এক রাতের এই কষ্ট আর কষ্ট থাকে না প্রিয়জনের সান্নিধ্যে। উৎসবের আনন্দ অতুলনীয় হয়ে ওঠে তখন।

No comments:

Post a Comment