Thursday, July 17, 2014

অবশেষে এসআই জাহিদ গ্রেফতার:নয়াদিগন্ত

অবশেষে মিরপুর থানার আলোচিত এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ। তার গ্রেফতারের খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত মাহবুবুর রহমান সুজনের মা ও পরিবারের সদস্যরা। তারা এসআই জাহিদের ফাঁসির জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান। এ দিকে ঘটনার পাঁচ দিন পরে জাহিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রহণের
প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। এতদিন তার বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলেও সুজনের পরিবারকে ফিরিয়ে দিয়েছে থানা পুলিশ। অবশেষে তারা আদালতে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে জাহিদ গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। ওই সূত্রমতে, এসআই জাহিদের বিরুদ্ধে হত্যা ও নারী শিশু নির্যাতনসহ দু’টি মামলা হতে পারে। তাকে রিমান্ডেও নেয়া হবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।  সুজনের স্ত্রী মমতাজ সুলতানা লুচি গতকাল বলেন, তার স্বামীর হত্যাকারী ওই দারোগার বিরুদ্ধে হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতনে পৃথক দু’টি মামলা করার ব্যাপারে তারা একমত হয়েছেন। গতকাল রাতের মধ্যে মামলা করা হতে পারে বলে তিনি জানান। তিনি আবারো এসআই জাহিদের ফাঁসি দাবি করেন। সুজনের মা সায়েদ বেগম বলেন, ঘটনার যেন সুষ্ঠু তদন্ত করা হয় সেই দাবি করছি। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা হলে এসআই জাহিদসহ সঙ্গীদের অবশ্যই ফাঁসি হবে। সুজনের ফুফাতো ভাই শাহাদাত হোসেন বলেন, এসআই জাহিদ পল্লবী থানায় কর্মরত অবস্থায় জনি নামে এক বিহারী যুবককে থানায় নির্যাতন করে মেরে ফেলে। এরপর জাভেদ হোসেন নামে আরো একজনকে হত্যা করেন তিনি। সেসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, এসআই জাহিদ মিরপুর মডেল থানার পুলিশ হওয়ার পরও তিনি শাহআলী এলাকার বিভিন্ন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলে টাকা দাবি করতেন। টাকা দিতে স্বীকার না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে গাড়িতে করে বিভিন্ন স্থানে ঘোরাতে থাকেন। সেই সাথে চালাতে থাকেন নির্যাতন। এক পর্যায়ে টাকা দিতে স্বীকার হলে তাকে ছাড়া হতো। এর পর ব্যাংকের মাধ্যমে হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। আর কেউ টাকা দিতে অস্বীকার করলে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দিতেন। আর এই কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিন ও শাহআলী থানার ওসি সেলিমুজ্জামান। শাহাদাত আরো বলেন, এসআই জাহিদের বাড়ি একটি বিশেষ জেলায় হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আমলে নেয়নি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। পুলিশের কোনো কোনো অফিসার তার এ ধরনের কাজ অপছন্দ করলেও কিছু বলতে পারতেন না।  সুজনের স্ত্রী মমতাজ সুলতানা লুচি জানান, গত শনিবার রাত ১২টার দিকে হাজারীবাগ থানাধীন শঙ্করের ১৫ নম্বর রোডের ২৭৭ নম্বর বাসায় মিরপুর থানার এসআই জাহিদসহ চার-পাঁচজন সাদা পোশাকধারী লোক এসে দরজায় নক করে। কে জানতে চাইলে বাইরে থেকে বলা হয় ‘আমরা সুজনের বন্ধু। দরজা খুলে দিলে এসআই জাহিদসহ পাঁচ-ছয়জন হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করে। এ সময় তারা জাহিদকে বেধড়ক মারধর করতে শুরু করে। লুচি ঠেকাতে গেলে তাকেও চুলের মুঠি ধরে মারধর শুরু করে। মাকে মারতে দেখে পাঁচ বছরের মোশাররফ চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করলে পুলিশ সুজনকে বাথরুমের মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানেই মারধর করে। এরপর পুলিশ তাদের তিনজনকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে লুচি ও ছেলে মোশাররফকে একটি রুমে রাখা হয়। সুজনকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য একটি রুমে। লুচি বলেন, পাশের রুম থেকে তিনি শুনতে পান তার স্বামী বাঁচার জন্য চিৎকার করছেন। একপর্যায়ে আমার স্বামী চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে, লুচি আমাকে বাঁচাও। আমাকে মেরে ফেললো। এরপর আর কিছু বলতে পারেনি। সকালে লুচি জানতে পারেন তার স্বামী ঢাকা মেডিক্যালে রয়েছে। সেখানে ছুটে গিয়ে মর্গে স্বামীর লাশ দেখতে পান। তিনি বলেন, সুজন এসআই জাহিদের হাত থেকে বাঁচতে মিরপুরের বাসা ছেড়ে শঙ্করে বাসা নিয়ে ছিলেন। তারপরও তাকে বাঁচতে দেয়নি। এ দিকে ওই ঘটনার পরই এসআই জাহিদকে কোজড করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাঠানো হয়। মিরপুর জোনের এডিসি মেহেদী হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়। কিন্তু নিহতের পরিবার পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলেও এতদিন মামলা নেয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম লেখালেখি হতে থাকে। অবশেষে গতকাল এসআই জাহিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ।  মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, এসআই জাহিদকে গতকাল বিকেলে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, সুজনের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরই জাহিদকে গ্রেফতার করা হয়।  সূত্র জানায়, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এই মৃত্যু হত্যাজনিত বলে প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ সুজনকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে তথ্য দেয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থানায় পৌঁছানো হয়। এসআই জাহিদুরের অপকর্ম : এসআই জাহিদুর রহমান পাঁচ বছরে বিভিন্ন সময়ে মিরপুরের কাফরুল, পল্লবী, শাহ আলী ও মিরপুর থানায় দায়িত্ব পালন করেন। এ কারণে মিরপুরের সব বিষয় ছিল তার নখদর্পণে। পল্লবীতে চাঁদার টাকা না দেয়ায় জনি নামে এক বিহারি যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সে সময় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও পরে তদবির করে তিনি শাহ আলী থানায় দায়িত্ব পালন শুরু করেন। শাহ আলী এলাকায় রিপন নামে চা-দোকানিকে তার সোর্স দিয়ে চোর সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পল্লবী এলাকায় কাঁচামাল ব্যবসায়ী কালু নামে এক যুবককে রাতে আটক করে থানায় নিয়ে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদার টাকা না দেয়ায় তার পায়ে রড ঢুকিয়ে নির্যাতন করেন। কালুর ভাই দেলোয়ার জানান, তার ভাই এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। শাহ আলীর দিয়াবাড়ির বাসিন্দা মামুন জানান, প্রায় সাত মাস আগে রাত ১২টার দিকে মিরপুরের কাজীপাড়ার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে ফিরছিলেন। তখন এসআই জাহিদুর তাকে সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যান। থানায় নিয়ে তার কাছে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। অন্যথায় ছিনতাইয়ের মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। হয়রানির ভয়ে তার পরিবারের সদস্যরা ধার করে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ওই রাতেই মামুনকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পুলিশের এসআই পদে যোগদান করেন জাহিদুর রহমান। মাদারীপুর সরকারি কলেজে অনার্স পড়াকালে ওই কলেজে প্রচার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ছাত্রলীগ করার সুবাদে স্থানীয় একজন সংসদ সদস্য তাকে পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) পদে চাকরি দেয়ার সুপারিশ করেন। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে জাহিদুর রহমানকে এসআই পদে চাকরিতে মনোনীত করা হয়।

No comments:

Post a Comment