পাসপোর্ট অধিদফতরে মেশিন রিড্যাবল পাসপোর্টের (এমআরপি) জন্য নিম্নমানের বই সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে যেমনি গ্রাহক হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তেমনি বিপুল অঙ্কের রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে সরকার। পাসপোর্ট অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ মেশিন রিড্যাবল পাসপোর্টের বই সরবরাহ করেছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরবরাহ করা এ বই খুবই নিম্নমানের। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহ করা বই
য়ের মধ্যে বেশি ত্র“টিপূর্ণ ও নিম্নমানের ৬৩ হাজার বই বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু বইগুলো সঠিক থাকলে সময়মতো প্রিন্ট করে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো হলে প্রতি বইয়ে কমপে তিন হাজার টাকা করে ১৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করতে পারত সরকার। পাশাপাশি ভোগান্তির হাত থেকে রা পেতেন গ্রাহক। অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, নিম্নমানের বইয়ের ব্যাপারে ইতোমধ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি জানিয়ে মেশিন রিড্যাবল পাসপোর্ট প্রস্তুতকারী প্রকল্পের উপপরিচালক লে. কর্নেল সাঈদ আহম্মেদ পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিলারুর সরবরাহ করা পাসপোর্ট বই খুবই নিম্নমানের। বইয়ের নম্বর খুবই অস্পষ্ট হওয়ায় প্রিন্ট করার সময় মেশিন পাঠ করতে পারছে না। তাই পাসপোর্ট বইয়ে যেখানে খোদাই করা নম্বর হওয়ার কথা সে জায়গা ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। আবার অনেক েেত্র বইয়ের নম্বর অস্পষ্ট থাকায় মেশিন ভুল নম্বর পাঠ করে ভুল নম্বর প্রিন্ট দিচ্ছে। পাসপোর্টের কভার শক্ত হওয়ায় প্রিন্টার মেশিনে জ্যাম সৃষ্টি করছে। এতে মেশিনের যন্ত্রাংশ ভেঙে যাচ্ছে। পাশাপাশি মূল্যবান মেশিনের আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে। শক্ত বুকলেটের আঘাত মেশিনের স্পর্শকাতর যন্ত্রাংশে লাগলে মেশিন স্থায়ীভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। অনেক েেত্র পাসপোর্ট বইয়ের মাঝখানের সেলাই ঠিকভাবে থাকে না। যে কারণে মেশিনে জ্যাম সৃষ্টি করে। ফলে অনেক পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যাচ্ছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয় পাসপোর্টের বই শক্ত হওয়ায় মেশিনের রোলার ঠিকভাবে রোল করতে পরছে না। এসব কারণে ইতোমধ্যে কয়েকটি রোলার ভেঙে গেছে এবং কয়েকটি প্রিন্টার মেশিনের তি হয়েছে। একই কারণে অসম রোলিংয়ের জন্য অতিরিক্ত প্রিন্টিং ওভারল্যাপিং হচ্ছে ও প্রিন্টিং সঠিক স্থানে হচ্ছে না। রোলার ভেঙে এর কার্যমতা হ্রাস পাচ্ছে। বার বার প্রিন্ট করার পরও সমস্যা থেকে যাওয়ায় প্রতিদিন প্রচুর পাসপোর্ট বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া পাসপোর্ট বইয়ের শেষ পাতায় অরিজিন্যাল বারকোডও কিছু কিছু পাসপোর্টে সঠিকভাবে মেশিন পড়তে পারে না। এ ছাড়া চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয় বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় স্মৃতিসৌধের ছবি গাঢ় হওয়ায় পাসপোর্টধারীর আল্ট্রাভায়োলেট ছবি অস্পষ্ট হচ্ছে। বইয়ের মেশিন রিড্যাবল এলাকায় লাল রঙের ফাইবার থাকায় কিছু কিছু পাসপোর্টের মেশিন রিড্যাবল কোড যন্ত্র দ্বারা পাঠ করা যাচ্ছে না বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে চিঠি দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। অথচ একাধিকবার বই প্রিন্ট ও প্রিন্টের সময় একের পর এক বই বাতিল হওয়ায় এক দিকে যেমন সময়মতো গ্রাহকদের পাসপোর্ট সরবরাহ করা যাচ্ছে না অপর দিকে ভুল প্রিন্টের কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গ্রাহক। পাশাপাশি সরকারের আর্থিক তি হচ্ছে। সূত্র জানায়, একটি এমআরপি বই ৩৮টি সিকিউরিটি ফিচার থাকার কথা। সেখানে ডিলারুর সরবরাহ করা এমআরপি বইয়ে ৩০টি সিকিউরিটি ফিচার ছিল, যা দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির হাতে ধরা পড়ে। কিন্তু এর পর ডিলারু বুকলেট সরবরাহ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত পরীা করা হয়নি যে প্রতিষ্ঠানটি ৩৮টি সিকিউরিটি ফিচার সংবলিত বই সরবরাহ করছে কি না। অথচ প্রতিটি সিকিউরিটি ফিচার ১০ সেন্ট হিসেবে ধরলে ডিলারু অতিরিক্ত ৮০ সেন্ট লাভ করে নিচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, ডিলারুর সরবরাহ করা বইয়ের মধ্যে ছায়া সংবলিত বাংলাদেশের মনোগ্রাম ও লেখা ডিজাইন অনুযায়ী হয়নি। তাই পাঠযোগ্য অংশ ঠিকভাবে পাঠ করা যায় না। বারকোডের ভেতরের নম্বর নয় সংখ্যা থাকার কথা থাকলেও নিজেদের ইচ্ছা মতো তা দশ সংখ্যা করা হয়েছে। পাসপোর্টের তিন নম্বর পাতা টেন্ডার ডকুমেন্টের সাথে সরবরাহ করা পাতার মতো হয়নি। তিন নম্বর পাতার প্রিন্ট করা ডাটাবেজ অংশের লাইনগুলোর মধ্যে জায়গা কম। এ ছাড়া লাইনগুলো যে ফন্ট অনুমোদন দেয়া হয়েছে সে ফন্ট দেয়া হয়নি। ডাটাবেজ প্রিন্ট করা অংশ দরপত্রে দেয়া পাতার মতো স্বচ্ছ নয়। ভিসা লাগানোর জন্য চার থেকে ছয়, নয় থেকে ষোল ও ছত্রিশ থেকে সাইত্রিশ পাতায় গ্রাফিক ডিজাইন নিম্নমানের। পেজ নম্বর আল্ট্রাভায়োলেট লাইট দিয়ে দেখার কথা কিন্তু এক থেকে ছয় পর্যন্ত পাতায় দেখা যায় না। ইংরেজিতে চৌদ্দ থেকে পনেরো পাতার নম্বর নেই। মহাস্থানগড়, কান্তজির মন্দির বাংলা বানান ভুল। ছবি প্রিন্টিংয়ের জায়গা ছোট হওয়ায় পাসপোর্টধারীদের ছবি সঠিক স্থানে প্রিন্ট করতে গিয়ে অনেক সময় পাসপোর্ট নষ্ট হচ্ছে। বাংলা পেজে নাম্বারিং মান খারপ। কভারে অনুমোদিত বাংলাদেশের মনোগ্রাম বড় করা হয়েছে। আবার দু’বারও মনোগ্রাম প্রিন্ট করা রয়েছে। কভারের ভেতরের পাতায় কালো রঙের পরিবর্তে অন্য রঙ দিয়ে লেখা হয়েছে। পাসপোর্টের ওপরে সোনালি রঙের লেখা মানসম্পন্ন নয়। দরপত্রের সাথে সরবরাহ করা বইয়ের কভারের চেয়ে বর্তমানে সরবরাহ করা বই অনেক নিম্নমানের। প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে হাতে লেখা পাসপোর্টের পরিবর্তে বাংলাদেশে চালু করা হয়েছে মেশিন রিড্যাবল পাসপোর্ট (এমআরপি) কার্যক্রম। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে ১৯০টি দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী মেশিন রিড্যাবল পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালের পর এমআরপি ছাড়া কোনো দেশে যাওয়া যাবে না। বিষয়টি মাথায় রেখে ২০১০ সালের ১ এপ্রিল থেকে এমআরপি ইস্যু শুরু করে বাংলাদেশ সরকার।
No comments:
Post a Comment