মিনি পার্লামেন্ট হিসেবে খ্যাত ‘সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’র অনেক সভাপতিই সাবেক মন্ত্রী। ফলে তাঁরা বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী নন। আবার বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদীয় কমিটির বৈঠকে নিয়মিত অংশ নিলেও সেখানে তাঁদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই। যে কারণে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো কমিটির বৈঠকে আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে না। ফলে সংসদীয় কমিটি এখন নিয়ম রক্ষার কার্যক্রমে পরিণত হয়
েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিগুলো ইতিমধ্যে নিয়মিত বৈঠক শুরু করেছে। কমিটিগুলো গত পাঁচ মাসে দেড় শতাধিক বৈঠক করেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু নিয়ে কোনো কমিটি আলোচনা বা সুপারিশ করেনি। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন ও ফেনীর উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যাকাণ্ড, বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাট, যোগাযোগব্যবস্থার দুরবস্থা, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের নির্যাতনের মতো চাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে নামমাত্র আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কমিটির পক্ষে ওই সব ঘটনা তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শুধু মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া সম্মাননা ক্রেস্ট নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে একটি সংসদীয় সাব কমিটি গঠন করা হলেও এর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ ইতিমধ্যে সাব কমিটি আভাস দিয়েছে, ওই সময়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা বর্তমান সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলামের জড়িত থাকার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। অথচ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে সাবেক প্রতিমন্ত্রীসহ ১৩ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ফলে অনেকেই এই তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, নবম সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের হার হতাশাজনক। যা ছিল ৫০ শতাংশেরও কম। তবে ওই কমিটিগুলোতে অনেক চাঞ্চল্যকর ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কারণ এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল। ওই সরকারের ও সেই সময়ে মন্ত্রণালয়ে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আলোচনায় বাধা বা কমিটির সভাপতিদের আপত্তি ছিল না। যে কারণে মন্ত্রণালয়গুলোতে আগের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে অনেক সাব কমিটি গঠন করা হয়। সাব কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে মামলারও রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি উল্টো। আগেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। এরপর তখনকার মন্ত্রীরা অনেকেই সভাপতির দায়িত্বে। সংসদ সচিবালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম, সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমিন, সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী এবং সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। যাঁদের বেশির ভাগই আগের মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন। এসব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে। মন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরে কয়েকজন অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে বিতর্কিত। ফলে এসব সভাপতির পক্ষ থেকে কমিটিকে কার্যকর করার উদ্যোগ না থাকাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সদস্যদের উদ্যোগী হওয়ার কথা থাকলেও তেমনটি হয়নি। সংসদ অধিবেশনে তাঁরা কিছুটা সরব থাকলেও কমিটিতে তাঁরা নীরব। এ পর্যন্ত কমিটির বৈঠকে তাঁদের পক্ষ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনা উত্থাপনের খবর জানা যায়নি। ফলে নিয়মিত বৈঠক করলেও কমিটিগুলো সংবিধান নির্দেশিত মূল দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদ ও সংসদের কার্যপ্রণািল বিধির ২৪৮ ধারায় বলা আছে, কমিটির কাজ হলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করা, প্রশাসন সম্পর্কে অনুসন্ধান করা, মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা এবং এ বিষয়ে সুপারিশ করা। যার মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। অষ্টম ও নবম সংসদে অনেকটা সফল হলেও এই সংসদে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেছেন। তবে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এই কমিটিগুলো অনেক বেশি কার্যকর হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, এখনো কমিটির কার্যক্রম মূল্যায়ন করার সময় আসেনি। তারা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তিনি বলেন, সাবেক মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে। ফলে তাঁদের যেকোনো সুপারিশ ও পরামর্শ করা সহজ হবে। এটা বিবেচনা করেই তাঁদের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এদিকে কমিটিতে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ মানতে নারাজ বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। কমিটির বৈঠকেও বিরোধীদলীয় সদস্যরা নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। তবে অনেকেই প্রথমবার সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় বিষয়গুলো বুঝে উঠতে সময় লাগছে। ভবিষ্যতে তাঁরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করবেন বলে তিনি দাবি করেন।
No comments:
Post a Comment