Saturday, July 26, 2014

কারাগারের রাজা জেলর মাহবুব:কালের কন্ঠ

গুরুত্বপূর্ণ কারাগারে দুই বছরের বেশি কোনো জেলরের দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকলেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর মাহবুবুল ইসলাম ব্যতিক্রম। তিনি ২০১০ সাল থেকে এ কারাগারে জেলরের দায়িত্বে আছেন। কারা কর্মকর্তাদের বদলি নিয়ে বাণিজ্য এবং বন্দি ও ম্যাটদের কাছ থেকে নিয়মিত উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে তাঁর বিরুদ্ধে। আরো অভিযোগ আছে, কারাগারে ভালো সেলে থাকার সুযোগ দিয়ে প্রতি বন্দির কাছ থেকে মাসে চার হাজার থেকে
১৫ হাজার টাকা নেন তিনি। কোন সেলে কী ধরনের খাবার যাবে, তাও নির্ধারিত হয় তাঁর কথায়। সব মিলিয়ে কারাগারের অঘোষিত ‘রাজা’ বনে গেছেন তিনি। কারাগার ও গোয়েন্দা সূত্র এবং ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। কারা সূত্রে জানা যায়, জেলার মাহবুব নিজেকে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক বলে দাবি করলেও তাঁর বিরুদ্ধে বন্দি জামায়াত নেতাদের সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। জেলারের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে কোলাকুলিও করেছেন। একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারাবন্দি জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে তাঁর কোলাকুলির ছবিও এসেছে কালের কণ্ঠের হাতে। কারাগারের একাধিক সূত্র জানায়, নতুন কোনো বন্দি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার পর তাকে গরু-ছাগলের মতো ‘বিক্রি’ করেন মাহবুব। সকালে ‘কেস টেবিলে’ গিয়ে তিনি ম্যাট, রাইটার এবং দালাল বন্দি ও রক্ষীদের মাধ্যমে বেচাকেনা শুরু করেন। কোনো বন্দি ৯০ সেলে যেতে চাইলে তাকে মাসে গুনতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। ১০ সেলে যেতে হলে সাত হাজার, ৭ সেলে ১৫ হাজার, ২০ সেলে চার হাজার, ২৭ সেলে পাঁচ হাজার এবং ৬ সেলে যেতে হলে সাত হাজার টাকা দিতে হয়। এতে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় হয়। সেই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। সবচেয়ে বেশি পান জেলার মাহবুব। যেসব বন্দির টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় সবচেয়ে কষ্টের সেল পদ্মা, মেঘনা, মনিহার, সুরমা ও যমুনায়। জেলার মাহবুবের বিরুদ্ধে অনুসারীদের দিয়ে কারাগারের ভেতরে মাদকদ্রব্য বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় শ্যামপুরের কমিশনার রোডের সোহেল আহমেদ গত বছর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন। তাঁকে সেখানে তিন মাসের বেশি সময় থাকতে হয়েছে মনিহার সেলে। তিনি জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সবচেয়ে কষ্টের সেল এটি। ছেলের কষ্টের কথা শুনে তাঁর বাবা লোকমান হোসেন লোক খুঁজতে থাকেন কিভাবে কারাগারে ছেলেটাকে একটু ভালো রাখা যায়। কারাগারের সামনে গিয়ে তিনি কাউকে খুঁজতে থাকেন। দুই দিন পর মনির নামের একজনকে পেয়েও যান। মনির তাঁকে বলেন, ১০ হাজার টাকা দিলে তিনি জেলারকে দিয়ে তাঁর ছেলেকে এক মাসের জন্য হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। অসহায় বাবা কিছু চিন্তা না করে ১০ হাজার টাকা তুলে দেন সেই মনিরের হাতে। পুরোটাই বিশ্বাসের ওপর। কারণ মনিরের কোনো পরিচয়ই জানতে পারেননি তিনি। তবে পরদিন ছেলেকে দেখতে গিয়ে লোকমান জানতে পারেন, তাঁর ছেলেকে সত্যিই কারা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজধানীর আজিমপুর এলাকার বাসিন্দা মো. বদরুল আলম কিছুদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। কয়েক মাস আগে তিনি জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মনিহার-২ সেলে বন্দি ছিলেন তিনি। সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান, কষ্টের অন্ত নেই। তবে ম্যাটকে টাকা দিলে কিছুটা শান্তি মিলত। সেলটিতে ধারণক্ষমতার ১০-১২ গুণ বেশি লোক থাকায় রাতে শোয়া বেশ কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। সংশ্লিষ্ট ম্যাটের হাতে কেউ ৫০০ টাকা গুঁজে দিলে একটু জায়গা মেলে। মেলে ভালো থালা, বাটি ও কম্বল। তিনি ১০ দিন কারাগারে থেকে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। বদরুল আলম বলেন, ‘কারাগার তো নয়, যেন দোজখ দেখে এলাম। কারো কপালে যেন ওই সেল না জোটে। যে কয়দিন ছিলাম, এক দিনও গোসল করতে পারিনি। আমি টাকা দিইনি বলে আমাকে অনেক কষ্টে থাকতে হয়েছে।’ কারা সূত্রে জানা যায়, নতুন আইজি প্রিজন্স যোগদানের পর জেলার মাহবুবকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বদলি করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি মাহবুবের রাজনৈতিক যোগসূত্র থাকায়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন গত বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিভিন্ন সোর্সে অভিযোগ পাই। আমরা সেটা ভেরিফাই (যাচাই) করে দেখি। যে অভিযোগের কথা বলছেন, তা হয়তো সত্যি। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে বলে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’ জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, কারা কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁদের বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকেও জেলার মাহবুবসহ কারাগারে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পরে সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সভাপতি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, কারাগারে যাঁরা দীর্ঘদিন একই জায়গায় থাকছেন তাঁরা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁদের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কারা সূত্রে জানা যায়, মাহবুবুল ইসলাম ডেপুটি জেলার হিসেবে কারা বিভাগে যোগ দেন ২০০৩ সালে। ২০১০ সালে তিনি জেলার হিসেবে পদোন্নতি পান। ওই সময় থেকেই তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাধারণ নিয়মে একজন কারা কর্মকর্তা তিন বছরের বেশি কোনো কারাগারে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। আর গুরুত্বপূর্ণ কারাগারগুলোতে দুই বছরের বেশি কোনো জেলারেরই দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকে না। একটি সূত্র মতে, এক-এগারোর পর সংসদ ভবন এলাকায় যে ভবনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্দি ছিলেন, সেখানে ডেপুটি জেলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন মাহবুব। সেই সুবাদে তিনি শেখ হাসিনার খুব কাছের মানুষ বলে কারাগারে প্রচার করে আসছেন। ওই প্রচারের কারণেই অনেকে তাঁকে সমীহ করে চলেন। আর এই প্রভাব খাটিয়ে জেলার মাহবুব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ‘রাজা’ বনে গেছেন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জেলার মাহবুব গত বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ ঠিক নয়। আমি একজন জেলার, আমি কিভাবে কাউকে বদলি করব? এত ক্ষমতা আমার কিভাবে হয়?’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তো জোর করে এখানে থাকছি না। আমাকে এখানে রাখা হচ্ছে বলেই আছি।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তো অনেকেরই যোগাযোগ থাকে। আমার থাকলে দোষ কি?’ বন্দি ‘বিক্রি’র বিষয়ে জানতে চাইলে জেলার বলেন, ‘বিভিন্ন সেলে বন্দি বণ্টনের দায়িত্ব পালন করেন ডেপুটি জেলাররা। আমি সেখানে বাণিজ্য করতে যাব কিভাবে?’

No comments:

Post a Comment