বাজারে বিক্রি হওয়া পাস্তুরিত বা প্যাকেটজাত তরল দুধে পাওয়া গেছে নিষিদ্ধ কীটনাশক অ্যালড্রিন। সম্প্রতি মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) পরীক্ষাগারে বাজার থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন কম্পানির তরল দুধের নমুনা পরীক্ষা করা হলে তাতে অ্যালড্রিনের উপস্থিতি ধরা পড়ে। অথচ ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের আশঙ্কায় দুই দশক আগেই ঘোষণা দিয়ে বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই কীটনাশকের ব্যবহার। সরকারি মান নিয়ন্ত্রণ
সংস্থা বিএসটিআইয়ের অনুমোদন পাওয়া বিভিন্ন কম্পানির তরল দুধেই অ্যালড্রিন পাওয়া যাচ্ছে। আবার বাজারে তরল দুধের সংকটের কারণে গুঁড়ো দুধের বিক্রি বেড়েছে। অথচ সেই গুঁড়ো দুধেরও প্রায় ৮৯ শতাংশই ভেজাল বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইপিএইচ। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুধ সংরক্ষণপ্রক্রিয়ার আদি দেশীয় পদ্ধতি- খেজুরপাতা, কলাপাতা বা কচুরিপানার বদলে এখন ফরমালিন, সোডিয়াম, বরিক পাউডার ও সোডার মতো ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হচ্ছে। আর দুধের পরিমাণ বাড়াতে পানি, স্টার্চ, চিনি কিংবা গুঁড়ো দুধের ব্যবহারও চলছে অনেক দিন ধরেই। দুধ সংগ্রহের পর তা আশপাশের বাড়ি কিংবা হাটবাজারে তাৎক্ষণিক বিক্রির দীর্ঘদিনের গ্রামীণ পদ্ধতি এখন আর নেই। চাহিদা মেটাতে দুধ প্রক্রিয়াজাত কম্পানিগুলোর স্থানীয় এজেন্টরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে তরল দুধ সংগ্রহ করেন। লম্বা সময় ধরে টাটকা রাখতে তাঁরা দুধে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশান। দুধের তীব্র ঘাটতি, অতি মুনাফার প্রবণতার সঙ্গে বেসরকারি কম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা, দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা, অপর্যাপ্ত শীতলীকরণ কেন্দ্রসহ তদারকির অভাবে তরল দুধে ভেজাল প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আইপিএইচ সূত্র জানায়, বাজারে নামিদামি ছয়টি ব্র্যান্ডের তরল দুধের মধ্যে পাঁচটিতেই পাওয়া গেছে অ্যালড্রিন। এই কীটনাশক রান্নার সময় তাপেও নষ্ট হয় না। ফলে খাবারের মাধ্যমে সহজেই তা মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। দেহের ভেতরে যাওয়ার পরে ফাংশন অরগানগুলো বিভিন্নভাবে নষ্ট করে দেয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। লিভার, কিডনি ও স্তন ক্যান্সার সৃষ্টি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দুই যুগ আগেই অ্যালড্রিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আইপিএইচের পরিচালক ডা. সুবিমল সিংহ চৌধুরী স্বীকার করেছেন, নামি-দামি ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত তরল দুধে অ্যালড্রিন ব্যবহারে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, যেসব খামারে গরু আছে, সেই খামারে ঘাসও উৎপাদন করা হয়। ঘাস চাষের সময় অ্যালড্রিন স্প্রে করা হয়। এতে ঘাসে কোনো ধরনের পোকামাকড় ধরে না। সেই ঘাস খাওয়ানোর ফলে খামারে গাভীর দুধে অ্যালড্রিন পাওয়া যাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইপিএইচের একজন ল্যাবরেটরি পরীক্ষক ও মান বিশ্লেষক জানান, বিশেষ করে পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জ এবং ঢাকার ডেমরার বিভিন্ন খামারে উৎপাদিত তরল দুধে অ্যালড্রিনের উপস্থিতি রয়েছে। তবে গ্রামের কোনো গাভীর দুধে এ কীটনাশক পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অ্যাডালটারেশন অব র মিল্ক ইন দ্য রুরাল এরিয়াস অব বরিশাল ডিস্ট্রিক্ট’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, দুধ দোহনের পর বাজারে আনার আগ পর্যন্ত বরিশাল অঞ্চলে গড়ে ১০ শতাংশ দুধে ফরমালিন এবং ২০ শতাংশে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট মেশানো হয়। শতভাগ দুধেই মেশানো হয় পানি। এ ছাড়া ২৬ শতাংশ দুধে চিনি, ১৪ শতাংশে গুঁড়ো দুধ এবং ১২ শতাংশে স্টার্চ মেশানো হয়। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তন্বী চন্দ এ গবেষণা পরিচালনা করেন। মানবদেহে অ্যালড্রিনের উপস্থিতির ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, অ্যালড্রিন মানবদেহে ঢুকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। হাড়, লিভার, ফুসফুস ও কিডনি রোগের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। হৃদরোগের ঝুঁকি ও ক্যান্সার বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। পুরুষের যৌনশক্তিসহ উর্বরতার সীমা কমিয়ে দেয়। নারীদের গর্ভপাত এবং মৃত কিংবা বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম দেওয়ার হার বেড়ে যায়। এদিকে ২০১২ সালে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্যানিটারি পরিদর্শকরা গুঁড়ো দুধের ১৮টি নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য আইপিএইচে পাঠান। পরীক্ষায় ১৮টি নমুনার মধ্যে ১৬টিতেই ভেজাল ধরা পড়ে। সে হিসাবে ৮৮.৮৯ শতাংশ গুঁড়ো দুধেই ভেজাল পাওয়া গেছে। আবার পূর্ণ ননিযুক্ত গুঁড়ো দুধে মিল্ক ফ্যাট থাকার কথা কমপক্ষে ২৬ শতাংশ। কিন্তু পরীক্ষাগারে অনুত্তীর্ণ নমুনাগুলোতে নির্ধারিত মাত্রার কম মিল্ক ফ্যাট পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, পূর্ণ ননিযুক্ত গুঁড়ো দুধে ননিবিহীন দুধ মেশানো হয়েছে। আইপিএইচের মতে, কোনো খাদ্যদ্রব্য থেকে কিছু তুলে নেওয়া বা অতিরিক্ত কিছু যোগ করা হলে সেটি ভেজাল বলে শনাক্ত করা হয়। গুঁড়ো দুধে সঠিক মাত্রার মিল্ক ফ্যাট না পাওয়ায় সেটি ভেজালের তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) সূত্র জানায়, গুঁড়ো দুধে ভেজাল শনাক্ত করতে কয়েকটি বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এগুলো হলো- মিল্ক ফ্যাট, আর্দ্রতা, মিল্ক প্রোটিন ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে উৎপাদন করা হয় কি না। পূর্ণ ননিযুক্ত গুঁড়ো দুধে ২৬ শতাংশ মিল্ক ফ্যাট, ৫ শতাংশ পনির ও ৩৪ শতাংশ মিল্ক প্রোটিন থাকতে হবে। এ বিষয়ে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. আকতারুন নাহার আলো বলেন, মানুষ উচ্চমাত্রার প্রোটিন পেতে পূর্ণ ননিযুক্ত গুঁড়ো দুধ ব্যবহার করে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দুধ থেকে ফ্যাট তুলে নেওয়ায় পুষ্টির মাত্রা কমে যায়। যদিও পুষ্টি কমলেও এ দুধ পানে ক্ষতির তেমন আশঙ্কা নেই। আইপিএইচের পরিচালক ডা. সুবিমল সিংহ চৌধুরী বলেন, ‘দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে স্যানিটারি পরিদর্শকদের পাঠানো নমুনা পরীক্ষা করে গুঁড়ো দুধে ভেজাল পাওয়া গেছে। আর বাজারে তরল দুধের মধ্যেও আমরা অ্যালড্রিন পেয়েছি। এটা নিষিদ্ধ আইটেম। এই আইটেম তো বাজারে আসার কথা নয়। তাই আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত কিভাবে এটা বাজারে প্রবেশ করেছে।’ নিষিদ্ধ সত্ত্বেও কিভাবে দেশে অ্যালড্রিন ঢুকছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘আমাদের দেশে পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো সরকারি নজরদারি নেই। কোনটি নিষিদ্ধ, কোনটি নিষিদ্ধ না, তা কেউ তদারকি করে না। যে পরিমাণ ফরমালিন দেশে ঢোকার কথা, বাস্তবে ঢুকছে তার চেয়ে অনেক বেশি। একইভাবে অ্যালড্রিনও ঢুকছে।’ বিএসটিআই অনুমোদিত তরল দুধে অ্যালড্রিনের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক বাবু কমল প্রসাদ দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা পরীক্ষার সময় এটার উপস্থিতি পাইনি। তবে যেহেতু অ্যালড্রিনের বিষয়টি উঠে এসেছে, তাই এখনই বিষয়টিকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে।’ সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা স্যানেটারি ইন্সপেক্টর মো. আলী জিন্নাহ বলেন, ‘আমরা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনাগুলো সংগ্রহ করে ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে দিই। দেড় থেকে তিন মাসের মধ্যেই আমাদের হাতে প্রতিবেদন চলে আসে। এরপর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘বাংলাদেশ খাদ্য আইন অধ্যাদেশ-১৯৫৯ এবং ২০০৫ (সংশোধিত) আইনের ৬(১)-এর (খ) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট ভেজাল পণ্যের কারখানায় অভিযান চালানো হয়। এ ছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এ সময় দায়ী ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিকভাবে জেল ও জরিমানা করা হয়।’ সিরাজগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে ভেজাল মেশানো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মিল্ক ভিটাসহ বেশ কয়েকটি দুধ কম্পানির কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। দুধে প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর সর্বনিু গুণগত মান না থাকায় ভেজাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই অভিযানটি প্রায় এক বছর আগে পরিচালনা করা হয়েছিল। সেই সময় দুধে অ্যালড্রিন ধরা পড়েনি। তবে সম্প্রতি পাঠানো নমুনাতে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষায় তরল দুধে বিষাক্ত অ্যালড্রিনের উপস্থিতি ধরা পড়ে। খামারে চাষ করা ঘাসের মধ্যে অ্যালড্রিন ব্যবহার করায় এমনটি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খামারের ঘাসে অ্যালড্রিন ব্যবহার সম্পর্কে পাবনার বেড়া উপজেলার ত্রিশালিখা গ্রামের কৃষক জহিরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের খামারে মেথিয়িন, জাম্বুসহ কয়েক প্রজাতির ঘাস চাষ করা হয়। আমরা ঘাসের মধ্যে ইউরিয়া ও জিংক সার ব্যবহার করি। কোনোভাবেই অ্যালড্রিন ব্যবহার করি না।’ তবে অন্য খামারিরা অ্যালড্রিন স্প্রে করে থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
No comments:
Post a Comment