Sunday, July 20, 2014

আব্বাস-খোকা দুই পক্ষই নাখোশ:কালের কন্ঠ

সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদারের প্রশ্নে বিএনপি কত দূর এগোতে পারবে তা নিয়ে দলটিতে আবারও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। বলা হয়েছিল- ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি হলে রাজধানীসহ সারা দেশে আন্দোলন জোরালো হবে। কিন্তু কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেই কমিটি গঠিত হওয়ার পর খোদ আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও উপদেষ্টা সাদেক হোসেন খোকা- এই দুই পক্ষের কেউই সন্তুষ্ট নয়। কারণ দুই পক্ষই মনে করছে, কমিটি তাদের অনুকূলে যায়নি। এর
আগে মির্জা আব্বাস নিজে দলীয় প্রধানের কাছে ৩১ সদস্যের কমিটির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে আলোচনাও এগোচ্ছিল। কিন্তু শুক্রবার রাতে হঠাৎ করে ৫৩ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে মির্জা আব্বাসের পক্ষ মনে করছে, খোকার পক্ষের লোকজনকে ঢোকানোর জন্যই এটা করা হয়েছে। আবার খোকার পক্ষ মনে করছে, কমিটিতে তারা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। এই অবস্থায় দুই পক্ষে নতুন করে বিরোধের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। গতকাল শনিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মহানগর কমিটি নিয়ে নেতা-কর্মীরা সন্তুষ্ট নয়। তাদের মনমরা ভাব। খোদ নতুন আহ্বায়ক দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস নিজেও ভরসা পাচ্ছেন না। কমিটির ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। গতকাল সারা দিন দলীয় নেতা-কর্মীরা তাঁর শাহজাহানপুরের বাসায় ফুল নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে গেলেও কারো সঙ্গে মন খুলে কথা বলেননি তিনি। ফুল গ্রহণ করেননি। অন্যদিকে সাদেক হোসেন খোকাসহ তাঁর সমর্থিত দলের নেতা-কর্মীরা আগে থেকেই ঢাকা মহানগর নতুন কমিটি গঠনে অনাগ্রহী ছিল। এ জন্য আব্বাসের নেতৃত্বে কমিটি হওয়ায় খোকার অনুসারীদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। সাদেক হোসেন খোকা বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকায় তারা এখনো প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ না করলেও নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। তবে হাবিব-উন-নবী খান সোহেল কমিটির সদস্যসচিব মনোনীত হওয়ায় তাঁর সমর্থিত নেতা-কর্মীরা বেজায় খুশি বলে দলের বিভিন্ন সূত্র জানায়। গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে। বিএনপি এখন সংসদের প্রতিনিধিত্বেও নেই, আবার রাজপথের আন্দোলনেও নেই। বিএনপি মনে করেছিল, ঢাকা মহানগর কমিটি গঠন করা হলে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই দীর্ঘ তিন বছর পর নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে। তিন বছর দুই মাস আগে সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্যসচিব করে যে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটিও আন্দোলন জোরদার করতে পারেনি। মির্জা আব্বাস ও খোকার মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের কথা চিন্তা করেই দুই গ্রুপের লোকজনকে এবার কমিটিতে রাখা হয়েছে। মূলত আন্দোলন জোরালো করার জন্যই দলের হাইকমান্ড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে গুলশান কার্যালয়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা আব্বাস ও দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন নেতা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেও মির্জা আব্বাসের প্রস্তাব মতে ৩১ সদস্যের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষমেশ ৫৩ সদস্যের কমিটি করে সেখানে খোকা ও আবদুস সালামকেও রাখা হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সাংবাদিকরা মির্জা আব্বাসের প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্য তাঁর বাসার বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। সাংবাদিকদের কথা জানার পর তিনি বাসার ভেতর থেকে বের হননি। সাংবাদিকরা চলে যাওয়ার পর তিনি বিকেল ৩টার পর বের হয়ে তাঁর রাজনৈতিক কক্ষে প্রবেশ করেন। সেখানে নগর কমিটির সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ছিলেন। তাঁরা দুজনে মহানগরের নতুন কমিটি গঠন কেমন হলো ও পরবর্তী সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া গতকাল নগরীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীরা মির্জা আব্বাসকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েও ফুল দিতে পারেননি। তিনি ফুল গ্রহণ না করে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুধু কেমন আছেন ইত্যাদি বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। তাঁর অনুসারী দলের নেতা-কর্মীরা জানায়, মির্জা আব্বাস নতুন কমিটি নিয়ে ভরসা পাচ্ছেন না। কারণ নতুন কমিটির কোনো বৈঠক হলে, সরকারবিরোধী আন্দোলনের কোনো কৌশল নির্ধারণ করা হলে তা সঙ্গে সঙ্গে খোকার অনুসারীরা ফাঁস করে দেবে। তাতে আন্দোলনের অনেক ক্ষতি হবে। আন্দোলন সফল হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলে মন্তব্য করে তারা। এদিকে কমিটি গঠনের পরপরই খোকাপন্থী কয়েকজন নেতা বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল বাশারের বাসায়ও কয়েকজন নেতা বৈঠক করেন। বৈঠকের পর তাঁরা কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যোগাযোগ করেন। তবে খোকাপন্থী কয়েকজন নেতা আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসকে টেলিফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বলে দলের বিভিন্ন সূত্র জানায়। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা এখন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, আন্দোলনে খোকা-সালামের ব্যর্থতার জন্য তাঁদের পরিবর্তে নতুন আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু এই কমিটির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে বিগত দিনের আন্দোলনের সময় মাঠে নামতে দেখা যায়নি। তাহলে এই ব্যর্থ নেতাদের দিয়ে কেন আবার আহ্বায়ক কমিটি করা হলো? তাহলে ঈদের পর যে আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে, তা কি সফল হবে? সূত্র জানায়, নতুন আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের দায়িত্ব পালন নিয়ে অনেকেই রয়েছেন অন্ধকারে। এ কমিটিতে উপদেষ্টাদের দায়িত্ব কী হবে তা নিয়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। কেউ কেউ আবার বিষয়টি নিয়ে উপহাসও করছেন। কারণ চার সদস্যের উপদেষ্টার মধ্যে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। ঢাকা মহানগর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে এ দুই সিনিয়র নেতার কোনোই সংশ্লিষ্টতা নেই। উপদেষ্টাদের এ দুজন মির্জা আব্বাসের পক্ষে কাজ করবেন। বাকি দুই উপদেষ্টা হলেন আগের কমিটির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা ও সদস্যসচিব আবদুস সালাম। যেখানে তাঁদের ব্যর্থতার জন্যই নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেখানে নতুন কমিটিতে তাঁরা কিভাবে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করবেন- এ প্রশ্নও উঠছে। তবে নতুন আহ্বায়ক কমিটির উপদেষ্টা আব্দুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকা মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে নতুন কমিটিকে তাঁরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। তবে আশা করব, নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ত্যাগী এবং যোগ্য নেতারা স্থান পাবেন। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালেদা জিয়া আমাদের ওপর যে গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন তা আমরা পালন করব। ঢাকা মহানগর কমিটিকে আন্দোলনের উপযোগী এবং শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করব।’ সবার কাছে তিনি দোয়া কামনা করেন। বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন কমিটিতে মির্জা আব্বাস অনুসারীদের পাল্লা ভারি। সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলও মির্জা আব্বাসের অনুসারী হিসেবে থাকবেন। আবার কমিটিতে থাকা খোকা অনুসারী বেশ ক’জন নেতা এখন পরিস্থিতির কারণে নিরপেক্ষ হয়ে পড়েছেন। ৬ যুগ্ম আহ্বায়কের মধ্যে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল আউয়াল মিন্টুও খোকা-আব্বাস প্রশ্নে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবেন। আর অন্য যুগ্ম আহ্বায়কদের মধ্যে সমবায়বিষয়ক সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহম্মেদ, কারাবন্দি সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু মির্জা আব্বাস অনুসারী। আর কাজী আবুল বাশার খোকার পক্ষে থাকলেও পরিস্থিতির কারণে খোকা অনুসারী এম এ কাইয়ুম ও আবু সাইদ খান খোকন পরিস্থিতির কারণে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছেন। জানা যায়, নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে ৪৪ জন সদস্যের মধ্যে ১ নম্বর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সরাসরি মির্জা আব্বাসের অনুসারী। এ ছাড়া প্রভাবশালী সদস্যদের মধ্যে যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, এস এ খালেক, আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। আর বরকতউল্লাহ বুলু ও ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম মির্জা আব্বাসকেই অনুসরণ করতে পারেন। আর বাকি সদস্যরা পরিস্থিতি বুঝে গোপনীয়তা রক্ষা করে তাঁদের অবস্থান গ্রহণ করবেন। এদিকে শনিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশে বিরাজমান সংকটের মধ্যেই বিএনপি নিজেদের গোছাতে চেষ্টা করছে। তাই ঢাকা মহানগরীর কমিটি দেওয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, মির্জা আব্বাস-সোহেলের বলিষ্ট নেতৃত্বেই ঢাকা মহানগরীতে বিএনপি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হবে। এ কমিটি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে। নতুন আহ্বায়ক কমিটি দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করছি।

No comments:

Post a Comment