Tuesday, July 22, 2014

নিহতের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ শ ছাড়িয়েছে:প্রথম অালো

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতম অভিযান বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। গতকাল সোমবার ১৪তম দিনে গড়িয়েছে এ অভিযান। অভিযানের একেকটি দিন যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে গাজায় কাফনে মোড়া শিশু-নারী-বৃদ্ধের লাশের সারি। বাড়ছে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। বাড়ছে মানবিক সংকট। এ অবস্থায় নিরাপত্তা পরিষদ গতকাল অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এসবে যেন কিছুই আসে যায় না ইসরায়েলের! বরং আরও বেপরোয়া ইসরায়েল। তা
রা গাজার মানুষের ওপর ব্যবহার করছে ‘নিষিদ্ধ’ ভয়ংকর একধরনের গোলা। তাদের শিকার থেকে বাদ পড়েনি হাসপাতালের রোগীরাও। একেবারে মৃত্যুপুরীতে পরিণত এখন গাজা উপত্যকা। গত রোববার সন্ধ্যা থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১০৭ জন। এ নিয়ে ৮ জুলাই অভিযান শুরুর পর গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের লাশের সংখ্যা ৫৫০ ছাড়িয়েছে। রোববার এ সংখ্যা ছিল ৪৪৫। যারা মারা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই বেসামরিক লোক। খবর বিবিসি, এএফপি, দি ইনডিপেনডেন্ট ও দ্য গার্ডিয়ানের। আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় চাপ সত্ত্বেও ইসরায়েলি বাহিনী গতকালও গাজার বিভিন্ন স্থানে চালিয়েছে উপর্যুপরি বিমান ও স্থল হামলা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে চলা এ অভিযানে গতকাল গাজায় প্রাণহানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬০ জনে। ফিলিস্তিনের জরুরি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, ইসরায়েলি বিমানের নিক্ষিপ্ত বোমায় গতকাল দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় একই পরিবারের নয়জন সদস্য নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে সাতটিই শিশু। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, গতকাল মধ্য গাজার দির আল-বালাহ এলাকার আল-আকসা মার্টায়ার্স হাসপাতালে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এতে নিহত হয় পাঁচজন। আহত হয় কমপক্ষে ৭০ জন। ফিলিস্তিনি জরুরি সেবা বিভাগের মুখপাত্র আশরাফ আল-কাদরা বলেন, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মী রয়েছেন অন্তত ২০ জন। অপরপক্ষে ইসরায়েলের দাবি, গতকাল ইসরায়েলি সেনা নিহত হয় সাতজন। গাজার উগ্রপন্থী গোষ্ঠী হামাসের রকেট হামলা ঠেকাতে পরিচালিত তাদের অভিযানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ২৭ ইসরায়েলি নাগরিক। এদের মধ্যে ২৫ জনই সেনাসদস্য। এ সংখ্যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ইসরায়েলের আরও দাবি, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু করা স্থল অভিযানের পর এ পর্যন্ত হামাসের অন্তত ১২০ সদস্যকে হত্যা করেছে তারা। তাদের মধ্যে গতকাল উত্তর গাজার ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ দিয়ে ইসরায়েলে অনুপ্রবেশের পর এক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ১০ হামাস সদস্য। এ সময় কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা আহত হয়। হামাসের সশস্ত্র শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেড ইসরায়েলে ঢুকে সেনাদের ওপর আক্রমণের দায় স্বীকার করে বলেছে, রোববার শাজাইয়াতে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জবাবেই এটি করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, গাজায় সহিংসতায় তাদের দুই নাগরিকও প্রাণ হারিয়েছে। তাদের পরিচয় প্রকাশ করা না হলেও মার্কিন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, তারা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মার্কিন সদস্য। ছুড়ছে ভয়ংকর গোলা: এটি দেখতে ছোট্ট তারকাঁটা বা তিরের মতো। এক মুখ সুচালো। অন্য মুখটা তিরের পেছন দিকটার মতো। এমন হাজার হাজার শলাকা ভরা আছে একটি গোলার মধ্যে। সেই গোলা (ফ্লেচেট শেল) ইসরায়েলি বাহিনী ছুড়ছে নিরীহ গাজাবাসীকে লক্ষ্য করে। ইসরায়েলি একটি মানবাধিকার সংগঠন বলছে, ‘মানবতার নীতি’ অনুযায়ী যুদ্ধের মধ্যেও এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার অবৈধ। কেননা, এতে বেসামরিক নিরীহ মানুষের ব্যাপক হারে হতাহত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। এ গোলা ইসরায়েল এর আগেও গাজায় ব্যবহার করেছে। এ ধরনের গোলা নিক্ষেপের জন্য সাধারণত ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা হয়। ছোড়ার পর এটি মাটিতে পড়ার আগে বাতাসেই বিস্ফোরিত হয়। এরপর এর মধ্যে থাকা হাজার হাজার ছোট্ট তিরের মতো শলাকাগুলো ছুটতে থাকে চারপাশে। লম্বা দেড় ইঞ্চির একটু বেশি এ শলাকাগুলো স্টিলের তৈরি। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার বরাত দিয়ে প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, গাজার খুজা এলাকায় ১৭ জুলাই এ ধরনের অন্তত ছয়টি গোলা নিক্ষেপ করে ইসরায়েলি বাহিনী। নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক: গাজায় রক্তপাত বন্ধে এখনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর তেমন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এ অবস্থায় বিরামহীনভাবে চলতে থাকা ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানি ক্রমাগত উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় এক জরুরি বৈঠকে বসে ১৫ সদস্যের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। জর্ডানের অনুরোধে গতকাল (নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় রোববার রাতে) বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক থেকে ইসরায়েল ও হামাসের প্রতি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়। তবে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়ে শক্ত কোনো প্রস্তাব উত্থাপন বা পাস হয়নি। দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় মিসরের উদ্যোগ ও জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের শান্তি মিশনের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। বান কি মুনের উদ্বেগ: চলমান গাজা পরিস্থিতিতে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন গতকাল বলেছেন, ইসরায়েলকে এ তাণ্ডব অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আর গাজার শাজাইয়া শহরে রোববার ইসরায়েলি অভিযানকে তিনি ‘একটি জঘন্য কাজ’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। রোববারের এ অভিযানে শুধু এ শহরেই নিহত হয় ৬০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এ ঘটনাকে গণহত্যা বলে অভিযোগ করেছেন। গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার আশায় বান কি মুন বর্তমানে কাতার, কুয়েত, মিসর, জর্ডান, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর সফরে রয়েছেন। গতকাল দোহা সফরকালে বান কি মুন ইসরায়েলের প্রতি সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের অনুরোধ জানান। মিসরে যাওয়ার আগে গতকাল কুয়েতে যাওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। বারাক ওবামার আহ্বান: নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গতকাল দ্রুত যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। গতকাল সকালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করে এ আহ্বান জানান তিনি। হোয়াইট হাউস বলেছে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে টেলিফোন আলাপকালে প্রেসিডেন্ট ওবামা দুই পক্ষের প্রাণহানিতে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। গত তিন দিনের মধ্যে এটি দুই নেতার দ্বিতীয় টেলিফোন আলাপ। গতকাল আলাপে ওবামা আবারও ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি তাঁর জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেন। ক্যামেরন-নেতানিয়াহু সংলাপ: গাজা পরিস্থিতি নিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনা করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও। এ সময় তিনি গাজার রকেট হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েলের সংগতিপূর্ণ পদক্ষেপের প্রতি যুক্তরাজ্যের জোরালো সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। মিসর সফরে জন কেরি: প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার আহ্বানের পর গাজা-সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজে বের করার আশায় গতকাল কায়রোতে রওনা হয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি ছাড়াও সেখানে কয়েকটি দেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা করার কথা রয়েছে। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গ্রহণ করা উদ্যোগের প্রধান মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসর। এদিকে সংকট নিয়ে গতকাল কাতারে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে হামাসের প্রধান খালেদ মেশালের বৈঠক করার কথা রয়েছে বলেও জানা গেছে। তুরস্কের তিন দিনের শোক: গাজায় ইসরায়েলি হামলাকে ‘গণহত্যা’ অভিহিত করে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে তুরস্ক আজ মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের জাতীয় শোক দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত এরিঙ্ক সাংবাদিকদের বলেন, ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশের লক্ষ্যে এ তিন দিনের শোক পালন করা হবে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের সর্বশেষ এ হামলার শুরু সম্প্রতি ইসরায়েলি তিন কিশোরকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ইসরায়েল এ জন্য হামাসকে দায়ী করলেও তারা তা অস্বীকার করে। পরে ফিলিস্তিনি এক কিশোর একইভাবে অপহরণ ও হত্যার শিকার হওয়ার পর উত্তেজনা নতুন মোড় নেয়। গাজা থেকে রকেট ছোড়া হচ্ছে—এমন অভিযোগ তুলে ইসরায়েল ৮ জুলাই শুরু করে ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’ নামের অভিযান। এর আগে ২০১২ সালের নভেম্বরে গাজায় অভিযান চালায় ইসরায়েল। তখন আট দিনের মাথায় মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল।

No comments:

Post a Comment