ফিলিস্তিনের গাজায় অব্যাহত অভিযানের মধ্যে ইসরায়েলি সংসদ সদস্য আয়েলেত শাকেদের দম্ভোক্তি, সব ফিলিস্তিনি মাকে মেরে ফেলতে হবে। ইসরায়েলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় তাঁর কথায়। অসহায় নিরপরাধ শিশুদের ‘ছোট সাপ’ হিসেবে অভিহিত করে শাকেদ বলেন, ‘চলমান অভিযানেই গাজার সব মাকে হত্যা করতে হবে, যাতে তারা আর সাপ জন্ম দিতে না পারে।’ রামাল্লায় ফিলিস্তিনের তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ সালের স
েপ্টেম্বর থেকে গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার ৫১৮ ফিলিস্তিনি শিশুকে মেরে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ওই ১৩ বছরে প্রতি তিন দিনে গড়ে একটি করে শিশুর প্রাণ নিয়েছে ইসরায়েল। এ ছাড়া ওই সময়ের মধ্যে ১৮ বছরেরও কম বয়সী ৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েলি সেনারা। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ইসরায়েলি হামলায় সাত হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ সময় সংঘাতে নিহত হয়েছে এগারো শরও বেশি ইসরায়েলি। কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ইসরায়েল যে নৃশংস, দানবীয় আগ্রাসন চালাচ্ছে তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ এ নিয়ে পশ্চিমা মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। জাতিসংঘের অব্যাহত ব্যর্থতা, দ্বিধাবিভক্ত আরব বিশ্বের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে গাজায় চলছে ইসরায়েলের রক্ত উৎসব। অথচ এই পশ্চিমা মানবাধিকার সংগঠন ও দেশগুলো বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বে পান থেকে চুন খসলেই নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে। দেশে দেশে তারা মানবাধিকার ফেরি করে বেড়ায়। অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবাধিকার ইস্যুকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে দাবি তাদের। বিশ্ব বিবেকের অজুহাতে তারা যেসব কথা বলে, তা অনেক সময় অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপকেও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু তাদের সেই বিবেক আজ কোথায়? বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলের বর্বরতার পরও কেন তারা নিশ্চুপ? হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো পশ্চিমা মানবাধিকার সংগঠনগুলো নানা ইস্যুতে বাংলাদেশকে চেপে ধরে। অথচ গাজায় হত্যাযজ্ঞের পরও সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন তাদের চোখে পড়ে না। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার ইস্যুতে সরব থাকে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে পর সেই পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইনভিত্তিক স্বাধীন সংবাদমাধ্যম মিন্ট প্রেস নিউজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক মিনার মুহায়েশ ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের জন্য পশ্চিমা গণমাধ্যমের দিকেও আঙুল তুলতে দ্বিধা করেননি। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, পশ্চিমা বৃহৎ গণমাধ্যমগুলো গাজায় ইসরায়েলের হামলা, সহিংসতার প্রকৃত সত্য আড়াল করছে। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম উল্লেখ করে সেগুলো বিশ্লেষণও করেছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘ডেথ টোল রাইজেস ইন গাজা, অ্যাজ হামাস হিটস নিউ টার্গেটস ইন ইসরায়েল’ (হামাস ইসরায়েলে নতুন নতুন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে গাজায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে)। মিনার মুহায়েশ বলেন, ইসরায়েল যে সবাইকে শাস্তি দেওয়ার অংশ হিসেবে বোমা হামলা চালাচ্ছে এবং আসলে বেসামরিক জনগণকে হত্যা করছে তা না বলে ওই প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের হতাহত হওয়ার দায় হামাসের ওপর চাপানো হয়েছে। ইসরায়েলও তার হামলায় ফিলিস্তিনিদের হতাহত হওয়ার জন্য হামাসকে দায়ী করছে। ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘ইসরায়েল টার্গেটস গাজা রকেট লঞ্চারস’ (গাজার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারীদের লক্ষ্য করে হামলা করছে ইসরায়েল)। ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে মিনার মুহায়েশ বলেন, ইসরায়েল যে গাজায় বেসামরিক বাড়িঘর লক্ষ্য করে হামলা করছে তার উল্লেখ নেই। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘প্যালেস্টানিয়ান রকেটস রিচ ফারদার ইনটু ইসরায়েল’ (ইসরায়েলের আরো ভেতরে এসে পড়ছে ফিলিস্তিনের ক্ষেপণাস্ত্র)। মিনার মুহায়েশ বলেন, ঘরে তৈরি ওই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলের একজনেরও মৃত্যু হয়নি- এমনটিই বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে আমেরিকার অর্থায়নে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রে সেদিন গাজায় ৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল এবং তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু- পত্রিকাটি তা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক খবরের মূল শিরোনাম ছিল, ‘গাজায় সংঘাতে দুই ইসরায়েলি সেনা নিহত’। শিরোনামে নিচের দিকে ছোট করে এসেছে, ‘হামাসের যোদ্ধাদের আক্রমণ জোরদারে নিহতের সংখ্যা ৩৩০ ছাড়িয়েছে।’ মিনার মুহায়েশ মনে করেন, স্বাধীন ও বিকল্প গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো গত পাঁচ বছরে ইসরায়েলকে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করছে। এ ক্ষেত্রে মূল ধারার পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। তারা বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নিয়েও কোনো প্রশ্ন তোলে না। আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক ড. এম শাহীদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বাস্তববাদী দৃষ্টিতে দেখে। তাদের কাছে ‘নৈতিকতা’ বিষয়টি জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পশ্চিমা বিশ্ব, তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইসরায়েলকে মাত্রাতিরিক্ত সমর্থন দেয়। শাহীদুজ্জামান আরো বলেন, বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে মানবাধিকার নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু এখন ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় নেই। এখানে নৈতিকতার চেয়ে জাতীয় স্বার্থই বেশি প্রভাব ফেলেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশ ফিলিস্তিনের ওপর হামলার সমালোচনা করলেও বেশির ভাগই ইসরায়েলকে সমর্থন করে। ড. এম শাহীদুজ্জামান বলেন, আরব বিশ্ব এখন বিভক্ত। সৌদি আরব, মিসর হামাসকে পছন্দ করে না। তাই হামাসের বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে সেটিকে তারা সমর্থন করে। তিনি মনে করেন, গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে। খুব শিগগির সেখানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে না। ইসরায়েল চাইবে, গাজায় ঢুকে হামাসের টানেলগুলো ধ্বংস করতে। ওই টানেলগুলো হামাসের তৎপরতার প্রাণশক্তি। তিনি বলেন, ইসরায়েলি সেনারা গাজায় ব্যাপক পরিসরে ঢুকলে হামাস গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারে। আর তাতে ইসরায়েল একটি শিক্ষা পেতে পারে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ব পরিচালনায় মোড়ল রাষ্ট্রগুলো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতি পালন করে। ক্ষমতাবান ইসরায়েলের জন্য এক রকম আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য অন্যরকম। যখন ইসরায়েল গাজায় বর্বর হামলা চালিয়ে মানবতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে তখন তারা নীরবতা পালনের মাধ্যমে ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে।’ মিজানুর রহমান আরো বলেন, ‘অপর দিকে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর চুন থেকে পান খসলেও তারা অতি মাত্রায় নাক গলায় এবং সারা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে। আমেরিকান, ব্রিটিশদের এমন আচরণ প্রমাণ করে যে তারা যা কিছু করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই করে। কোথায় মানবাধিকার বিপর্যয় ঘটছে আর কোথায় ঘটছে না সেটি তাদের মূল বিষয় নয়।’ তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে দেশে সিভিল সোসাইটি (নাগরিক সমাজ) নামে একটি শ্রেণী আছে। তাদের আচরণও বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর মতোই। পশ্চিমাদের লগ্নি করা অর্থে তাঁরা চলেন। পশ্চিমাদের স্বার্থে কোনো ব্যাঘাত ঘটলেই তাঁরা মাঠ কাঁপান।’ ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয় ও ছোটখাটো কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তাঁরা (নাগরিক সমাজ) তা পশ্চিমাদের নজরে আনেন। কিন্তু গাজায় মানবতার চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তেও তাঁরা নির্বাক। তৃতীয় বিশ্বে এ রকম সিভিল সোসাইটি (নাগরিক সমাজ) পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য হাসিলের কাজ করে। গাজায় বর্বর হামলার সময়ও তারা নীরব থেকে পশ্চিমাদের অনুসরণ করে।’ বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট এলিনা খান ইসরায়েলের হামলার বিষয়ে পশ্চিমাদের নীরবতা প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, এটি বরাবরের ঘটনা। যখন কোনো বিশেষ জাতি অধ্যুষিত রাষ্ট্র ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র কোথাও হামলা করে তখন জাতিসংঘ, নিরাপত্তা পরিষদ ও এর স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলো একদম নীরব থাকে। তিনি বলেন, ইসরায়েল এবার গাজায় হামলা চালিয়ে শতাধিক শিশুকে হত্যার পরও তারা (পশ্চিমা দেশগুলো) চুপ। ওই হামলা ও হত্যার ঘটনা সারা বিশ্বকে নাড়া দিলেও তথাকথিত ওই মোড়ল রাষ্ট্রগুলোয় এর কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রভাব পড়লেও তারা তা চেপে রেখেছে। এর মূল কারণ তাদের জাতীয় স্বার্থ। এলিনা খান আরো বলেন, জাতীয় স্বার্থ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শতাধিক নিষ্পাপ শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ হত্যা করা হলেও তথাকথিত ওই মোড়ল দেশগুলোর কিছু আসে যায় না। এর পরও যদি তারা কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনার প্রতিবাদ করে তাহলে আমাদের বুঝতে হবে যে সেখানে তাদের কোনো স্বার্থ রয়েছে। যেমন বেশ কিছু দিন আগে সিরিয়া ইস্যুতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র যে খেলায় মেতে উঠেছিল তাতে বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছে যে সেখানে ওই দুই দেশেরই স্বার্থ আছে। এলিনা খান বলেন, স্বার্থের প্রয়োজনে তথাকথিত ওই বিশ্ব মোড়লরা কখনো সরব হয়, আবার কখনো নীরবতা পালন করে। গাজায় ইসরায়েলের হামলায় তারা নীরবতা পালন করছে বা তেমন সরব হচ্ছে না। কারণ ইসরায়েল তাদের মিত্র। ইসরায়েলের স্বার্থের সঙ্গে তাদের স্বার্থ জড়িত। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের পক্ষে বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান অভিন্ন। ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশ জোরালো ভাষায় ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, দানবরূপী ইসরায়েলকে রুখতে পশ্চিমা দেশগুলো উদ্যোগ নিয়ে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানাবে।
No comments:
Post a Comment