সকাল সাড়ে ১০টায় গাবতলী বাস টার্মিনালে অপেক্ষা করছেন কয়েক হাজার মানুষ। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ কোনোমতে বসে সময় কাটাচ্ছেন। সবার মুখে বিরক্তির চিহ্ন। সকাল ৮টায় যে গাড়ি ছাড়ার কথা তা ১০টায়ও ছাড়ার খবর নেই। এ নিয়ে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। গতকাল ভোর থেকেই এভাবে নানা দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয় ঘরমুখো মানুষকে। শুধু বাসেই নয়, ট্রেন এবং লঞ্চেও নানা ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় যাত্রীদের। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সূত্র জানায়,
দিন যত যাবে ভোগান্তি ততই বাড়বে। তাদের আশঙ্কা এবার বাড়িতে সবার ঈদ না-ও হতে পারে। ঈদের দু-একদিন আগে রওনা দিয়েও রাস্তায়ই ঈদ করতে হতে পারে। ফেরিঘাটগুলোর ব্যবস্থাপনাও খুবই নাজুক বলে অনেকে জানিয়েছেন। গতকালই ফেরিঘাটে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। গতকাল থেকেই ট্রেনের শিডিউলও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। এ দিকে যানবাহনের ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। যে যেভাবে পারছে গলাকাটা ভাড়া আদায় করছে যাত্রীদের কাছ থেকে। এ দিকে টার্মিনালগুলোতে নিরাপত্তাহীন যাত্রীরা প্রতিনিয়ত খোয়াচ্ছেন অর্থকড়ি ও মালামাল। ঘর থেকে বের হয়েই ভোগান্তি শুরু : গাবতলী বাস টার্মিনালে একাধিক যাত্রী গতকাল সকালে জানালেন ঘর থেকে বের হয়েই পড়তে হয় নানা ঝক্কি ঝামেলায়। সকালে গাড়ি ধরতে ভোরে সেহরি খেয়ে আর ঘুমাতে পারেননি। সকাল ৮টার গাড়ি ধরতে সকাল ৬টার মধ্যে বাসা থেকে বের হতে হয়েছে ফকিরাপুলের আলিমের। তিনি জানান, সকালেই বাসা থেকে বের হন। সকালে সিএনজি অটোরিকশায় গাবতলী পৌঁছতে তিনগুণ টাকা দিতে হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটি সিএনজি অটোরিকশা পেয়েছেন। গাবতলী এসে দেখেন গাড়ি নেই। এরপর থেকে আবারো অপেক্ষার পালা। কামাল নামে অপর এক যাত্রী জানালেন, ভোরে বাসা থেকে নেমে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতেই চরম ভোগান্তি। বাসা থেকে বের হয়ে কোনো রিকশাগাড়ি নেই। শেষ পর্যন্ত একটি রিকশা পেয়েছেন অন্তত তিনগুণ বেশি ভাড়ায়। বাধ্য হয়েছেন ওতেই চড়তে। এরপর রাস্তায় দুর্বৃত্তদের ভয়। আতঙ্কের মধ্যে পৌঁছতে হয়েছে গাবতলী টার্মিনালে। এসে দেখেন গাড়ি নেই। সায়েদাবাদ টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। গাড়ি আছে। যাত্রীরাও গাড়িতে উঠে বসে আছেন। কিন্তু যানজটের কারণে গাড়ি টার্মিনাল ছাড়তে পারছে না। এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা টার্মিনালেই বসে থাকতে হচ্ছে গাড়িগুলোকে। আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া : অনেকে যানবাহনের অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করতে না পেরে তারা বিকল্প পথে ঘরে ফিরছেন। তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। সূত্র জানায়, গুলিস্তান থেকে মাওয়ার ভাড়া ৬০ থেকে ৮০ টাকা। কিন্তু ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ১২০ টাকা। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হলেও দেখার কেউ নেই। ঢাকা থেকে আরিচা এবং পাটুরিয়ার ভাড়া ১০০ টাকার কম হলেও ঈদ উপলক্ষে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ১৫০ টাকার ওপরে। প্রতিবাদ করতে গেলে পরিবহন শ্রমিকদের হাতে নাজেহাল হতে হচ্ছে যাত্রীদের। তা-ও আবার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে না দিয়ে কয়েক কিলোমিটার আগে থেকেই যাত্রীদের নামিয়ে দেয়া হচ্ছে গাড়ি থেকে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি আরো বাড়ছে। লঞ্চে উপচেপড়া ভিড় : গতকাল বিকেলে দেখা গেছে লঞ্চগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। কোনো নিয়মনীতি না মেনে লঞ্চগুলোতে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। নিয়ম ভেঙে যাত্রী বহন করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি দিতে মোবাইল কোর্টসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে লঞ্চ মালিকেরা কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করছেন না। এ দিকে লঞ্চগুলোতে বাড়তি ভাড়া আদায়ের পর অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিট বাণিজ্য করে লঞ্চের শ্রমিকেরা বাড়তি অর্থ আদায় করে নিচ্ছেন। সূত্র জানায়, ঈদ মওসুম এলেই অসাধু শ্রমিকেরা এই কাজ করে থাকে। লঞ্চমালিক এবং প্রশাসনের লোকজন এসব জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ঝালকাঠীর যাত্রী কাজি বাশার জানান, তিনি দুইজন বসতে পারেন এরূপ একটু স্থানের জন্য এক দালালকে ২০০ টাকা দিয়েছেন, যা লঞ্চ ভাড়ার প্রায় সমান। ঈদ রাস্তায় করতে হবে : অনেকেরই এবারের ঈদ রাস্তায় করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। মন্ত্রী রাস্তা সংস্কারের দাবি করলেও এখনো ৪০ ভাগও সচল হয়নি। এতে মহাসড়কে তীব্র যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, রাস্তাঘাটের এ বেহাল দশার কারণে দু-এক দিন আগেও রওনা দিয়ে অনেকের পক্ষে বাড়িতে ঈদ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। অন্য পরিবহন নেতা আলী রেজা বলেন, রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই নাজুক। চালকেরা ঠিকমতো গাড়ি চালাতে পারছেন না। মহাসড়কে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। স্বাভাবিক গতি না থাকায় মহাসড়কে তীব্র যানজটের আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সূত্র জানায়, আজ থেকেই মহাসড়কে তীব্র যানজট হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ফেরিঘাটে তীব্র জট : গতকাল সকাল থেকেই মাওয়া ফেরিঘাটে তীব্র জট লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয় সূত্র জানায়, সকালে ৭ শ’র মতো গাড়ির জট লেগে যায়। আস্তে আস্তে এ জট বাড়ে। তবে বিকেল ৪টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত মাওয়া ঘাট দিয়ে গাড়ি পার হয়েছে ১২শ’র মতো। মাওয়া ঘাটে এ চাপ আজ আরো বাড়বে বলে ঘাট সূত্র জানায়। এতে মানুষের ভোগান্তি আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। চলছে লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন : ঈদ মওসুমে বাড়তি উপার্জনের জন্য এক শ্রেণীর পরিবহন মালিক লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন রাস্তায় নামিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি নামীদামি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঈদ মওসুম এলেই অসাধু মালিকেরা এ সুযোগটি নিয়ে থাকে। সূত্র জানায়, মালিকদের অতি মুনাফার লোভে সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে পারেন। ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুধু বাসই নয়, নৌযানের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটছে। ফিটনেসবিহীন বেশ কিছু নৌযান ঈদ মওসুমে যাত্রী পরিবহনে নেমেছে বলে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, যাদের বিষয়টি তদারকির কথা তাদের ম্যানেজ করেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন। নিরাপত্তাব্যবস্থা বিঘিœত : এ দিকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় যাত্রীদের ঘরে ফিরতে হচ্ছে। রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এবং কমলাপুর রেলস্টেশন ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, যতটা নিরাপত্তা দেয়ার কথা ছিল তার সিকিভাগও নেই। আর এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গাবতলী বাস টার্মিনাল সূত্র জানায়, গতকাল অন্তত পাঁচজনের পকেটমারের ঘটনা ঘটেছে। মহাখালী টার্মিনালে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হলেও এখানেও যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
No comments:
Post a Comment