Saturday, July 26, 2014

থামছেই না ইয়াবার চোরাচালান:নয়াদিগন্ত

মারণনেশা ইয়াবা চালান আসছে একের পর এক। ঈদকে কেন্দ্র করে যেন উৎসবে মেতে উঠেছে ইয়াবা কারবারিরা। মিয়ানমার, পাকিস্তান ও ভারত সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা চালান নিয়ে আসছে ইয়াবা ডনরা। আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা লোকাল ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।  এ দিকে কম-বেশি চালান আটক হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। কিন্তু ধরা পড়ছে না গডফাদার বা ইয়াবার আসল কারবারিরা। ফলে দমানো যাচ্ছে না ইয়াবা। আইনশৃঙ্
খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেও তৎপর ইয়াবা ডিলার বা ব্যবসায়ীরা। এক দিকে ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে, অন্য দিকে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বড় বড় চালান নিয়ে আসছে ইয়াবা মাফিয়ারা। ইয়াবা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, অলিগলিতে বিক্রি হচ্ছে এই মারণনেশা। সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও গোয়েন্দা সংস্থা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা তৈরি করে। ওই তালিকার হিসাব অনুযায়ী প্রায় সাড়ে সাত হাজার ইয়াবা ব্যবসায়ী সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও নামী-দামি মডেল রয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে কিছু ইয়াবা বহনকারী এবং পাড়া মহল্লার মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে সরকার কর্তৃক তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদাররা। এসব ইয়াবা গডফাদার এতটাই ক্ষমতাসীন যে, এদের ধারে কাছেও ভিড়তে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চলতি মাসে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় দেড় লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ সময় সরকারের তালিকাভুক্ত অন্যতম ইয়াবা ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান বিজিবি সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। ওই দিন দুপুরের দিকে টেকনাফের নাফ নদীর আড়াই নম্বর স্লুইস গেট এলাকায় এ উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। বিজিবির উদ্ধার করা ইয়াবা ট্যাবলেটের চালানের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় বলে জানিয়েছেন বিজিবি কর্মকর্তারা। অভিযান চলাকালে পালিয়ে যাওয়া যুবক জিয়াউর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনের তালিকাভুক্ত চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী বলে পুলিশ ও বিজিবি জানিয়েছে। বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, বিজিবির একটি টহল দল নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে ঘটনাস্থল পৌঁছে ইয়াবা ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমানকে এ চালানটি নিয়ে যেতে দেখে। এ সময় তাকে ধাওয়া করলে সে তিনটি প্যাকেটে থাকা ইয়াবা ট্যাবলেটগুলো ফেলে পালিয়ে যায়। পরে বিজিবি ওই তিন প্যাকেট থেকে দেড় লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে। এ ঘটনায় জিয়াউর রহমানকে পলাতক আসামি দেখিয়ে টেকনাফ থানায় বিজিবি মামলা করেছে। গোয়েন্দা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বেশির ভাগ ইয়াবা প্রবেশ করছে মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদী হয়ে। প্রায় প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে ট্রলারে ইয়াবার চালান আসছে টেকনাফে। সূত্র মতে, সাইফুল্লাহ নামে এক মাফিয়া মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে। মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে তার ইয়াবা তৈরির কারখানা রয়েছে। সাইফুল্লাহ মিয়ানমারের নাগরিক হয়েও সে এখন বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ে এই মাদকের সাম্রাজ্য পরিচালনা করছে।  স্থানীয় সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসায়ের সূত্র ধরে মিয়ানমারের অধিবাসী সাইফুল্লাহর বাংলাদেশের টেকনাফে আনাগোনা শুরু হয়। সেই সূত্র ধরে সে এক সময় স্থানীয় প্রভাবশালী আব্দুল্লাহ ও তার ভাই জিয়াউর রহমানের সাথে সখ্য গড়ে তোলে। একপর্যায় সে আবদুল্লাহ ও জিয়াউর রহমানের বোনকে বিয়ে করে। এরপর থেকে সে বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ে মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ইয়াঙ্গুনে তার রয়েছে ইয়াবা তৈরির কারখানা। সেখান থেকে সে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। আর বাংলাদেশে শ্যালক ও জিয়াউর রহমান ইয়াবা ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করে। টেকনাফ থেকে ইয়াবা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তাদের নেতৃত্বে অন্তত ৩০০ জন মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। গোয়েন্দাদের কাছে ইয়াবা ডন সাইফুল্লাহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকার পরেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে সে। বেশির ভাগ সময় সে মিয়ানমারে অবস্থান করায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে।   গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তালিকার পর তালিকা করা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বহন করতে সহজ হওয়ায় মাদকের মধ্যে এখন ইয়াবা বেচা-কেনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। পুলিশ-র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারাও মনে করছেন, এই মুহূর্তে ইয়াবা ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে যুবসমাজ আরো ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার ও ব্যবসায়ী গ্রেফতার হচ্ছে। কিন্তু এর পরও দমানো যাচ্ছে না। গ্রেফতারকৃতরা সহজেই জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারো একই কাজে জড়িয়ে পড়ছে।  সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ-র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য অধিদফতর ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা তৈরি করে। তালিকায় উল্লেখ করা হয়Ñ ঢাকার আনাচে-কানাচে দেদার ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে বস্তি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ ও গেস্ট হাউজগুলোতে বিক্রি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রিকশা ও ভ্যানচালকবেশে অলিগলিতে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা। সূত্র মতে, তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আমিন হুদা, জুয়েল, তমাল, মুশফিকুর রহমান তমাল, শাহেদ, মুন্না, হেলাল, জাহাঙ্গীর, শাহিনুর, আল-আমিন, জসিম, লোকমান, রাসেল, সজল সোহেল, রানা, ডালিম, নান্টু, আক্কাস, হাফিজুর ইকবাল, ইসমাইল, বাকি মিয়া, জাহাঙ্গীর, সুজন মিয়া, মাহমুদুর রহমান, কবির, রিনা আক্তার, সুমি আক্তার, লাকির মা, উর্মি গ্রুপের সদস্যরা ঢাকায় ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত রয়েছে।  এ ছাড়া ঢাকার বাইরে আইয়ুব খান, রশিদ খান, বেকু, ইউনুছ, এমদাদ মোল্লা, জাফর আহম্মদ, হাসেম মেম্বার, আবদুল্লাহ, জিয়াউর রহমান, দিদার, হাসান, রমজান চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সক্রিয়। মূলত মিয়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে টেকনাফে আসা ইয়াবার চালান তারাই সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। তালিকাভুক্তদের অনেকে ইতঃপূর্বে একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তারা জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে আবারো একই কাজ করছে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে মাফিয়াচক্র। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় থেকে এরা সব সময়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে র‌্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করতে কয়েক দফা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। টেকনাফ থেকে ইয়াবা চালান এনে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এ ব্যবসায়ের সাথে অনেক রাঘব-বোয়াল জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।

No comments:

Post a Comment