ব্যবসায়ী ফরহাদ ইসলাম অপহরণের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা-কর্মীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে করা মামলা আর চালাতে চায় না ভুক্তভোগী পরিবার। আসামিপক্ষের আপসের চেষ্টা, ভয়, থানা-পুলিশের নির্লিপ্ততার কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। আতঙ্কে ঢাকাও ছেড়েছেন ফরহাদ। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, আসামিদের বাঁচাতে ছাত্রলীগের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন নেতা চাপ দেওয়ায় পুলিশ এখন অনেকটাই নীরব এই মামলার
ব্যাপারে। ফলে তদন্ত কার্যত থেমে গেছে। পুলিশ ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখায় পরিবারটিও ভীতির মাঝে আছে। ফরহাদ রাজধানীর ফকিরাপুলে মুঠোফোন রিচার্জের ব্যবসা করতেন। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। রাজধানীর পল্টন থানা এলাকায় এক বাসায় মা-বাবা ও দুই ভাইবোন নিয়ে তাঁর বসবাস। গত ৮ মে ফরহাদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে অপহরণ করে জগন্নাথ হলের একটি কক্ষে আটকে রাখেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরিবার বিষয়টি শাহবাগ থানার পুলিশকে জানায়। মুক্তিপণ দেওয়ার কৌশল করে পুলিশ পরদিন ৯ মে ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা-কর্মীসহ সাতজনকে আটক করে এবং ফরহাদকে উদ্ধার করে। কিন্তু অভিযোগ ওঠে, ঊর্ধ্বতন এক নেতার চাপে আটক ছাত্রলীগের এক নেতাকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ছয়জনকে অপহরণের ঘটনায় শাহবাগ থানায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের (স্নাতকোত্তর) ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপ-ক্রীড়া সম্পাদক সৃজন ঘোষ ওরফে সজীব, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ছাত্র জগন্নাথ হল কমিটির সহসভাপতি অনুপম চন্দ্র, ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও মুহসীন হল কমিটির ছাত্রবৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, একই হলের ছাত্রলীগের কর্মী ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হিমেল, ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের কর্মী বাপ্পী ও আরফান নামের এক যুবক। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সৃজন, অনুপম, মামুন ও হিমেলকে সাময়িক বহিষ্কার করে। ছাত্রলীগ থেকেও তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। পুলিশ ও পরিবার জানায়, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছেন আরফান। আরফান ফরহাদের বন্ধু ও একই এলাকার। ফরহাদকে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে দিতে পারলে ছাত্রলীগের ওই নেতাদের দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন আরফান। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ প্রথমে আরফানকে ও পরে বাকি পাঁচজনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বর্তমানে গ্রেপ্তার ছয়জন কারাগারে আছেন। ঘটনার পর থেকে আতঙ্কে ফকিরাপুলের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন ফরহাদ। ফরহাদের পরিবারের সঙ্গে আসামিপক্ষের কয়েকজন দেখা করে আপসের প্রস্তাব দিয়েছেন। এতে রাজি হয়ে ফরহাদের পরিবার আদালতেও গিয়েছিলেন। তবে মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভব হয়নি। এখন পরিবার মামলা চালাতে রাজি নন। জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শিমুল কুমার প্রথম আলোকে বলেন, এখানে আর তদন্তের কিছু নেই। সবকিছুই প্রমাণিত। আসামিদের স্থায়ী ঠিকানা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট থানার প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। আসামিদের রক্ষায় ছাত্রলীগ নেতাদের চাপ সম্পর্কে জানতে চাইলে এসআই শিমুল কুমার বলেন, ‘কয়েকজন নেতা ফোন করে আসামিদের যাতে সমস্যা না হয় সে ব্যাপারে একটু দেখার জন্য অনুরোধ করেছেন। তবে কেউ চাপ সৃষ্টি করেননি।’ ‘ওই নেতারা কারা?’ জানতে চাইলে এসআই বলেন, ‘নাম মনে নাই।’ সম্প্রতি এ ব্যাপারে জানতে পল্টনের বাসায় গেলে ফরহাদের খালু আবুল কালাম বলেন, ‘আসামি একজনের বাবা আইসা কোর্টে গিয়া অভিযোগ সত্য নয় বলার জন্য অনুরোধ করছিল। আমরা তো ভাই এমনিতেই ভয়ে আছি। পোলা পাইছি। আর কিছুর দরকার নাই। মামলা আর চালাতে চাই না। তাই আদালতে গেছিলাম।’ কাঁদতে কাঁদতে ফরহাদের মা ফরিদা বেগম বলেন, ‘এলাকার কয়েকজন কইতেছে, ফরহাদরে নাকি মাইরা ফেলব। তাই তারে আর ঢাকায় রাখি নাই। আমরা গরিব। মামলা চালানোর মতো টাকা নাই। তার ওপর আসামিরা ভার্সিটির ছাত্র। আমার পোলার ওপর অনেক নির্যাতন করছে তারা। আমরা কি ওদের লগে পারমু?’ ‘কেউ হুমকি দিয়েছে কি না’—জানতে চাইলে ফরিদা বেগম বলেন, ‘না, তয় এলাকার কয়েকজন বলতাছিল, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো কিছু না বলতে। সমস্যা অইতে পারে।’ ফরিদা বলেন, ‘আরফান খুব খারাপ ছেলে। সে-ও কোনো সমস্যা করতে পারে। আরফান বেশি লেখাপড়াও জানে না। তার লগে ভার্সিটির পোলাপাইনদের সম্পর্ক দেইখাই তো ভয় লাগতেছে।’
No comments:
Post a Comment