একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধান রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধকালে অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন এবং অপরাধী সংগঠনের বিচার সহজ করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছে। এ ছাড়া মামলাসংখ্যা
কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুটি থেকে একটিতে কমিয়ে আনারও চিন্তাভাবনা চলছে। ট্রাইব্যুনালস আইন সংশোধন করা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিষয়টি আপনারাও জানবেন।’ মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের বিরুদ্ধে গত বছরের আগস্ট মাসে তদন্ত শুরু হয়। চলতি বছরের ২৫ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা। এরপর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ প্রস্তুতির কাজ শুরু করে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে ২৯ মে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের বিদ্যমান আইনে সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধান নেই। এ বক্তব্যের পর জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রস্তুতিতে ছেদ পড়ে। জামায়াতের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, সরকার জামায়াতের বিচার করতে চায় না। এই অবস্থায় আইন মন্ত্রণালয় সংগঠনেরও শাস্তির বিধান রেখে আইনটি সংশোধনের কাজ শুরু করে। মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, এই সংশোধনীতে ট্রাইব্যুনালস আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ‘ব্যক্তি’ শব্দটির পর ‘অথবা সংগঠন’ শব্দগুলো সন্নিবেশ করা হচ্ছে। আরেকটি ধারায় ‘দায়’ শব্দটির পরিবর্তে ‘অথবা সাংগঠনিক দায়’ শব্দগুলো এবং অপর ধারায় ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংগঠন’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপনের চিন্তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সংগঠন হিসেবে দোষী প্রমাণিত হলে ওই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যমান আইনে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার করার বিধান থাকলেও সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তাই ওই শব্দগুলো সন্নিবেশ ও প্রতিস্থাপন হলে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচার করতে আইনি বাধা থাকবে না। এই সংশোধন হলে তা হবে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ চলাকালে দ্বিতীয় দফায় আইন সংশোধন। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। তরুণ প্রজন্ম ওই রায় প্রত্যাখ্যান করে এবং কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে তোলে। তারা সরকারের কাছে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের দাবি জানায়। কিন্তু তৎকালীন আইনে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ছিল না। ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের বিধান রেখে আইনটির সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করে এবং চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। গত ১২ ডিসেম্বর ওই রায় কার্যকর হয়। জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তুরিন আফরোজ বলেন, ‘আইনের কী সংশোধন হচ্ছে, তা এখনো জানি না। তবে শাস্তির বিধান যুক্ত হলে সে ক্ষেত্রে আমরা সেভাবেই মামলা পরিচালনা করব।’ ট্রাইব্যুনাল একটিতে কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা: আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ট্রাইব্যুনাল-১ ও ট্রাইব্যুনাল-২-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারকাজ চলছে। মামলাসংখ্যা কমে যাওয়ায় দুটি ট্রাইব্যুনালকে একটিতে কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা চলছে। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ট্রাইব্যুনাল-১-এ একটি মামলার ও ট্রাইব্যুনাল-২-এ দুটি মামলার বিচারকাজ চলছে। আর কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তুরিন আফরোজ বলেন, ‘মামলার প্রয়োজনেই দুটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছিল। সুতরাং এখন একটি করলে সমস্যা দেখি না।’ রাষ্ট্রপক্ষ: মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কেঁৗসুলি দল পুনর্গঠনের চিন্তাও চলছে। রাষ্ট্রপক্ষের কেঁৗসুলিদের সমন্বয়ক পদে আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান সমন্বয়ক ছিলেন। মে মাসে তাঁকে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে অব্যাহতি দিলে সমন্বয়কের পদ থেকেও তিনি বাদ পড়েন। রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কেঁৗসুলি পদেও পরিবর্তন আসছে বলে জানায় ওই সূত্র।
No comments:
Post a Comment