ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ৮ দিন ধরে চলা ইসরাইলি হামলা ও সহিংসতার অবসানে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল মিসর। এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে ‘যুদ্ধবিরতি’র ঘোষণাও দিয়েছিল তেল আবিব। কিন্তু ৬ ঘণ্টা না যেতেই বিকালে ফের বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ‘গ্রহণ’ করলেও তা প্রত্যাখ্যান করে হামাস। আর ‘যুদ্ধবিরতি’র পর ৫০টি রকেট হামলা চালিয়েছে হামাস- এ অভিযোগ তুলে ফিলিস্তিনে ফে
র হামলা চালায় ইসরাইল। ৮ দিনের সংঘাতে মঙ্গলবার নিহতের সংখ্যা ঠেকেছে ১৯২ জনে। আহতের ক্ষেত্রে তা দেড় হাজার ছুঁই ছুঁই। হামলায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়িতে এখনও আর্তনাদ চলছে, ধ্বংসস্তূপে ধুলো আর পাথরে মিলেমিশে একাকার ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষের রক্ত-মাংস। আর সব হারানোর আশংকায় এখনও ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। অবশ্য এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ইসরাইলের কেউ-ই নিহত হয়নি। গাজায় সংঘাত বন্ধে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সোমবার মিসরের রাজধানী কায়রোতে জরুরি বৈঠকে বসেন আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। বৈঠক শেষে মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন ধাপের যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন। ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ১২ ঘণ্টার মধ্যে উভয় পক্ষ শর্তহীনভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করবে। গাজার সীমান্ত খুলে দেয়া হবে। এরপর কায়রোতে দুই পক্ষই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আলোচনায় বসে পূর্ণাঙ্গ চুক্তিতে পৌঁছবে। প্রস্তাবিত ওই সময় অতিক্রমের আগেই প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরাইলের মন্ত্রিসভা মঙ্গলবার সকালে (স্থানীয় সময়) যুদ্ধবিরতি চুক্তি গ্রহণের পক্ষে (৬-২) ভোট দেয়। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে দাবি করা হয়, সকাল ৯টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ইসরাইলের দুটি টেলিভিশন চ্যানেল ও কয়েকটি সংবাদ সংস্থাও এদিন বিভিন্ন স্থানে ইসরাইলি সৈন্যদের বিশ্রাম নেয়ার ছবিও প্রকাশ করে। কিন্তু স্থানীয় সময় বিকাল ৩টা নাগাদ গাজার দুটি লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগ ও সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা দাবি করেন, আমরা তাদের ওপর আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছি। হামাস যুদ্ধবিরতি মানেনি। বরং আমাদের লক্ষ্য করে ৫০টি রকেট হামলা করেছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস মিসরের এ পদক্ষেপকে (যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব) স্বাগত জানিয়েছেন। তবে প্রস্তাবের ব্যাপারে গাজার হামাস কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। হামাসের সামরিক শাখা কাশেম ব্রিগেডের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি ‘আত্মসমর্পণ’ সমতুল্য আখ্যা দিয়ে এদিন তা নাকচ করা হয়। কাশেম ব্রিগেডের পক্ষ থেকে বলা হয়, শত্র“দের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। গাজায় হামাসের মুখপাত্র সামি আবু জুহারি বলেন, অস্ত্রবিরতির আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব নিয়ে মিসরীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের কোনো আলোচনাই হয়নি। বিপরীতে, হামাসের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুসা আবু মারজুক কায়রো থেকে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে (হামাসের শীর্ষ নেতা) এখনও আলোচনা চলছে। একের পর এক হামলায় এরই মধ্যে বহু বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইলেরই এক মুখপাত্র বলেন, গাজায় এক হাজারের বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে তারা। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইলের সর্বশেষ হামলার সূত্রপাত ইসরাইলি তিন কিশোরকে সম্প্রতি অপহরণ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে। হামাসই ওই ঘটনা ঘটায় বলে মনে করে ইসরাইল। তবে হামাস তা অস্বীকার করে আসছে। পরে ফিলিস্তিনি এক কিশোরকে একইভাবে হত্যা ও অপহরণের পর উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। এরপর গাজা থেকে রকেট ছোড়া হচ্ছে- এমন দাবি তুলে ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’ শুরু করে ইসরাইল। কয়েক দিনের বিমান হামলার পর শনিবার রাতে স্থল অভিযানে নামে ইসরাইলি নৌ কমান্ডোরা। পাল্টা জবাব দিতে গাজা থেকে রকেট ছোড়া হয়। এর আগে ২০১২ সালের নভেম্বরে গাজায় অভিযান চালিছিল ইসরাইল। তখন ৮ দিনের মাথায় মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। বেশিরভাগই মারা যাচ্ছে নারী ও শিশুরা : গাজায় ইসরাইলি হামলায় বেশিরভাগই মারা যাচ্ছে নিরীহ নারী-পুরুষ আর নিষ্পাপ শিশুরা। ঘরের কোণে মায়ের কোলে থাকা শিশুর প্রাণ যাচ্ছে আকাশ থেকে ফেলা বোমায়, বাবার হাত ধরে পথে নামা শিশুও মরছে একইভাবে। অনেক আদরের ছোট্ট সোনার ছোট্ট শরীরটি সাদা কাপড়ে মুড়ে মা তুলে দিচ্ছেন বাবার হাতে, দাফন করতে। কাঁদছেন সবাই। কখনও-বা কাঁদার মতোও কেউ থাকছেন না, পরিবারের ছোট-বড় সবাই মিলে চাপা পড়ছেন বিমান হামলায় ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসাবশেষের নিচে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী ৮ দিনে সপ্তাহে বিমান থেকে ফেলা বোমা ও স্থল অভিযানে নিহত হয়েছে অন্তত ১৯২ জন। এদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছেন প্রায় দেড় হাজার জন। যাদের অনেকের অবস্থাই আশংকাজনক। আবার বেঁচে থাকলেও এদের অনেককেই বরণ করতে হবে পঙ্গুত্ব। জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা জানিয়েছে, ‘জঙ্গিদের’ লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হচ্ছে বলে ইসরাইলের দিক থেকে বলা হলেও হামলায় এ পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছে, তাদের ৭৭ শতাংশ নিরীহ মানুষ। এ হামলায় সহস্রাধিক বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে পালানো প্রায় ১৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে জাতিসংঘের শিবিরে। ফিলিস্তিনকে মেনে নিতে রাজি নয় ইসরাইল : ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে^র জের ধরে ফিলিস্তিনের দুই অংশ পশ্চিম তীর ও গাজা ২০০৭ সালের আগস্টে চলে যায় দুটি দলের নিয়ন্ত্রণে। সেই থেকে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ পশ্চিম তীরে ও খালেদ মেশালের নেতৃত্বে হামাস গাজা শাসন করছিল। এ অবস্থায় গত এপ্রিলে দুই দলের মধ্যে চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী নতুন করে নির্বাচনের পর চলতি বছরের শেষ নাগাদ একটি জাতীয় সরকার গঠনের কথা। কিন্তু হামাস-ফাতাহর চুক্তিকে ভালোভাবে নেয়নি ইসরাইল। তাদের মতে, হামাস একটি জঙ্গি সংগঠন। হামাস-ফাতাহ জাতীয় ঐক্যের সরকার হলে সেই সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় যাবে না বলে জানিয়ে দেয় দেশটি। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের শুরু। এরপর থেকে নিয়মিত রক্ত ঝরলেও আজও তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বাধীন সত্তা মেনে নিতে রাজি নয় ইসরাইল।
No comments:
Post a Comment